জলবসন্ত বা চিকেনপক্স হলে করনীয় এবং এর দাগ দূর করার উপায়.!

chicken pox

জলবসন্ত বা চিকেনপক্স (Chickenpox) অত্যন্ত সংক্রামক একটি রোগ যা ভ্যারিসেলা জুস্টার ভাইরাস নামক এক ধরনের ভাইরাসের সংক্রমনে হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্তের হার বসন্তকালে সবচেয়ে বেশি হয়। সাধারণত শিশুরা সহজেই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এটি ভাইরাসবাহিত একটি রোগ এবং অত্যন্ত ছোঁয়াচে। একজন থেকে খুব দ্রুত অন্যজনে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সাধারণত কেউ একবার এই রোগে আক্রান্ত হলে, জীবনে তার আর এ রোগ হয় না।

কীভাবে এ রোগ ছড়ায়?

জলবসন্ত বা চিকেনপক্স অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় এটি খুব সহজেই একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন- আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে, আক্রান্ত রোগীর ব্যবহূত জিনিস স্পর্শ করলে, আক্রান্ত রোগীর নিঃশ্বাসের মাধ্যমে, আক্রান্ত রোগীর হাঁচি ও কাশি থাকে এ রোগটি ছড়াতে পারে। ভেরিসেলা জোস্টার নামক একটি ভাইরাস এ রোগের জন্য দায়ী। ভাইরাসটি দেহে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই কোন লক্ষণ দেখা যায় না। যেহেতু ভেরিসেলা ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার ১৪ থেকে ২১ দিন পর ধীরে ধীরে পক্সের উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে, তাই আক্রান্ত রোগীর শরীরে ফুসকুড়ি ওঠার ৫ দিন আগে থেকে এবং ফুসকুড়ি শুকিয়ে যাওয়ার পরবর্তী ৬ দিন সময়ের মধ্যে কেউ সংস্পর্শে এলে তারও জলবসন্ত বা চিকেনপক্স হতে পারে।

লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ…

  • সাধারণত ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ১১ থেকে ২২ দিন পর্যন্ত কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না। এ সময়ের মধ্যে ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। পরবর্তী সময়ে হঠাৎ করেই জ্বর দিয়ে জলবসন্তের লক্ষণ প্রকাশ প্রায়। জ্বরের সাথে শরীরব্যথা, মাথাব্যথা, শরীরে ম্যাজম্যাজ ভাব ইত্যাদি থাকতে পারে।
  • দ্বিতীয় দিন থেকে জ্বরের সাথে শরীরে, বিশেষ করে বুকে ও পিঠে বিশেষ ধরনের গুটি গুটি উঠতে শুরু করে।
  • পরবর্তীতে তা বড় হয়ে কেন্দ্রে পানি জমা হয়। এর আবরণ খুব পাতলা হওয়ায় অল্পতেই ফেটে যেতে পারে।
  • এরপর শরীরের বাইরের দিকের অঙ্গসমূহে (যেমন— হাত, পা, মুখ, মাথার ত্বক ইত্যাদি) গুটি উঠতে শুরু করে, তবে হাত ও পায়ের তালুতে গুটি দেখা যায় না।
  • এসময় পুরো শরীরে বিভিন্ন বয়সের গুটি থাকে। পরে তা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়।
  • সাধারনত গুটিগুলো বেশ চুলকায়। চুলকালে গুটি ফেটে গিয়ে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে এবং পরে স্থায়ীভাবে দাগ হয়ে যেতে পারে।
  • গুটি ওঠার সময় এটি অন্যকে বেশি সংক্রামক হয়, তাই এ সময় বাইরে না যাওয়া বা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকতে হবে। এটি গুটি শুকানো পর্যন্ত অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে।

জলবসন্ত হলে করণীয়…

জলবসন্ত ছোট বা বড় সবাইকে আক্রমণ করতে পারে৷ সাধারনত এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে এই অস্বস্তিকর অবস্থা থাকে৷ প্রথমে সামান্য জ্বর এবং পরবর্তীতে ফোস্কা পড়ে, চুলকানি হয় এবং অবশেষে ফোস্কা শুকিয়ে তা থেকে শুকনো মরা চামড়া উঠে আসে৷ সাধারনত এটি মারাত্মক কোন রোগ নয়। আবার এটি মূলত জীবনে একবারই হয় অর্থাৎ একবার হলে সাধারনত জীবনে আর এই রোগটি হয় না। জলবসন্ত হলে করনীয়-

  • জ্বর বা ব্যথার কারণে অস্বস্তিবোধ হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। আবার শিশুর বয়স দু বছরের কম হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে৷
  • হালকা পোশাক পরিধান করতে হবে। কারন ভারী পোশাকে অস্বস্তি আরও বেড়ে যেতে পারে। তাই, রোগীকে ভারী কিংবা বেশি কাপড় না পরিয়ে হালকা সুতির কাপড় কিংবা পায়জামা পরান৷
  • রোগীকে শরীর ঠান্ডা করুন রোগীর শরীরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য এতে রোগী আরাম বোধ করবে৷ তবে খেয়াল রাখবেন পানি যেন বেশি ঠান্ডা না হয়৷
  • রোগীকে একটা ঠান্ডা ভেজা কাপড় দিয়ে ত্বক মুছে দিতে পারেন কিংবা ঠান্ডা পানিতে গোসল করাতে পারেন৷ এতে তার ত্বক সজীব এবং পরিষ্কার থাকবে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করবে। তাই, রোগীকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে এবং প্রতিদিন রাতে শোবার সময় পরনে থাকা জামা কাপড় পাল্টে পরিষ্কার কাপড় পরাতে হবে৷
  • শরীরে চুলকানি হতে পারে কিন্তু শরীরে চুলকানো যাবে না। এটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে। কারণ- চুলকানোর ফলে ক্ষত হবে এবং ত্বকে স্থায়ী দাগ পড়ে যেতে পারে। আবার সংক্রমণও হতে পারে। তারপরেও খুব বেশি চুলকানি হলে রোগীকে একটা ঠান্ডা, ভেজা নরম কাপড় দিতে হবে যাতে সে তা দিয়ে আস্তে আস্তে ফোস্কার ওপর ঘষতে পারে৷ এটা ফোস্কা না ফাটিয়ে ত্বককে ক্ষতের হাত থেকে রক্ষা করবে। আবার অতিরিক্ত চুলকানি নিয়ন্ত্রণের জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন নামক মুখে খাওয়ার ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। এটি চুলকানি কমানোর পাশাপাশি ঘুমের জন্যও ভাল। এতে রোগীর চুলকানিও কমবে আবার বিশ্রামও হবে।
  • শিশুদের ক্ষেত্রে, জলবসন্তে আক্রান্ত হলে তার আঙুলের নখ ছোট করে কেটে দিতে হবে৷ এমনকি অসুখ সেরে যাবার পরও কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত তার নখ প্রতি সপ্তাহে দুবার কেটে দিতে হবে। এতে সে নখ দিয়ে চুলকালেও ত্বকে দাগ পরবে না এবং জীবাণুর সংক্রমণও কম হবে।
  • ত্বকে সংক্রমণের চিহ্ন দেখা দিলে অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। পক্সের চারপাশে লাল হলে বা পক্সের মুখে পুঁজ হলে, সেখানে অ্যান্টিবায়োটিক মলম লাগাতে হবে।
  • জলবসন্তের সংখ্যা অনেক বেশি হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে৷
  • যার জলবসন্ত হয়েছে কিংবা সম্প্রতি জলবসন্ত থেকে সেরে উঠেছে এদের সবাইকে সূর্যালোকের ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক হতে হবে। কারন- একবার জলবসন্ত হবার পর ত্বক প্রায় একবছর পর্যন্ত অরক্ষিত অবস্থায় থাকে এবং সূর্যালোকে সহজেই পুড়ে যেতে পারে। এসকল ক্ষেত্রে, ঘরের বাইরে বেরোনোর সময় সমস্ত শরীরে ভালভাবে সানস্ক্রিন মেখে নিলে ভাল উপকার পাওয়া যাবে।

টিকা…
জলবসন্ত প্রতিরোধের জন্য টিকা নেওয়া যেতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে, ১২ থেকে ১৫ মাস বয়সে প্রথম ডোজ ও ৪ থেকে ৬ বছর বয়সে দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। অপরদিকে ১৩ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে, ৪ থেকে ৮ সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি ডোজ নিতে হবে। কিন্তু গর্ভবতী মা এবং রোগাক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ টিকা নেওয়া যাবে না।

চিকিৎসা…
জলবসন্ত বা চিকেনপক্স এ আক্রান্ত রোগী সাধারণত এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তারপরেও কিছু সতর্কতা রোগীর কষ্ট কমাতে এবং সংক্রমন প্রতিরোধে অনেক কার্যকর হতে পারে। জলবসন্তে ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তা করতে হবে। এ রোগে চিকিৎসা বলতে মূলত উপসর্গ কমানোর চিকিৎসাই করা হয়ে থাকে। যেমন-

  • অতিরিক্ত চুলকানির জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
  • জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে।
  • সংক্রমন প্রতিরোধের জন্য ৫ থেকে ৭ দিন অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
  • ব্যথা হলে পেইনকিলার খেতে পারেন।
  • ত্বকে সংক্রমন হলে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের পাশাপাশি ত্বকে ব্যবহারের জন্য ক্লোরহেক্সিডিন অ্যান্টিসেপটিক মলম লাগাতে পারেন।
  • রোগের প্রকোপ কমানোর জন্য অ্যান্টিভাইরাল জাতীয় ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। তবে গর্ভবতী এবং শিশুদের ক্ষেত্রে,
  • যেকোনো ওষুধ সেবনের পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে।

আরও কিছু ব্যপারে সতর্ক হলে রোগীর জন্য তা আরামদায়ক বা স্বস্তিদায়ক হতে পারে। যেমন-

  • রোগীকে আলাদা ঘরে রাখতে হবে।
  • রোগীর ত্বক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রতিদিন রাতে শোবার সময়, সারাদিনের পরা পোশাক পরিবর্তন করে নতুন পোশাক পরিয়ে দিতে হবে এবং বিছানার চাদর পরিবর্তন করতে হবে।
  • নখ ছোট রাখলে সংক্রমন প্রতিরোধের পাশাপাশি ক্ষত হওয়ার হাত থেকে ত্বককে রক্ষা করা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে, নিয়মিত অর্থাৎ সপ্তাহে দুইবার নখ কেটে দিতে হবে।
  • বেশি করে পানি ও তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে।
  • মুখে ক্ষত হলে নরম খাবার খেতে হবে। এবং ঝাল, লবণ ও মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া কমাতে হবে।
  • হালকা পোশাক শরীরের জন্য অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক। তাই, টাইট কাপড়চোপড় না পরে সুতি ঢিলেঢালা জামা কাপড় এবং রাতে পায়জামা পরলে স্বস্তিবোধ হবে।

জলবসন্ত হলে কি হতে পারে?

সাধারনত জলবসন্ত তেমন মারাত্মক কোন রোগ নয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে গুটি থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে আবার নিউমোনিয়া, হেপাটাইটিস, মস্তিষ্কে প্রদাহ, কিডনির প্রদাহ, ত্বকের প্রদাহ, অস্থিসন্ধির প্রদাহ ইত্যাদি হতে পারে। গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে, জলবসন্ত গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটির কারন হতে পারে। আবার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে কিংবা কোন ওষুধের কারনে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এ রোগটিও মারাত্মক হতে পারে।

সবশেষে…

জলবসন্ত বা চিকেন পক্স সাধারনত এমনিতেই ভাল হয়ে যায়, আবার এটি কোন মারাত্মক রোগও নয়। তবে, কিছু ব্যপারে সতর্ক হলে রোগীর জন্য একটি স্বস্তিদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় এবং সংক্রমন প্রতিরোধ করা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে, গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে এবং অসুস্থ্য বা শারীরিকভাবে দুর্বল ব্যক্তির ক্ষেত্রে, বেশি সতর্কতার প্রয়োজন আছে এবং অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে হবে। কোন ধরনের ওষুধ ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *