অনিদ্রা কি? অনিদ্রাকে দূর করার উপায়.!

insomnia

সারাদিন কাজ কর্মের পরে একটি নির্দিষ্ট সময় ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজন। বিভিন্ন সময় ঘুমের সমস্যা প্রায় সবার ক্ষেত্রেই হয়। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এটাকে খুব সাধারন একটা ব্যপার মনে করে কোন গুরুত্বই দেই না। কিন্তু, সারাদিনের কাজকর্ম শেষে শরীর ও ব্রেন দুটোরই বিশ্রাম দরকার হয়। ঘুমের সমস্যা নিয়মিত চলতে থাকলে এটি ক্রনিক হয়ে যায় এবং এটি একটি অসুখে পরিনত হয়। এটাই অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া। সাধারণত খেটে খাওয়া পরিশ্রমী মানুষের চেয়ে একটু উচ্চবিত্ত ও পরিশ্রমে অভ্যস্ত নন এমন মানুষের মাঝে এই রোগটি বেশি হয়ে থাকে।

প্রতিদিন কতটুকু ঘুম প্রয়োজন?

স্বাভাবিক বা সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। কাজের চাপ বা ব্যস্ততা খুব বেশি থাকলেও প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। দিনে ৬ ঘণ্টার কম ঘুমালে সেটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারন হতে পারে। ঘুমানোর মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, অনেক রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকা যায়, মন সতেজ থাকে আবার কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ঘুমানোর সময় শরীরের কোষগুলোর পুনর্জন্ম ঘটে এবং সেইসঙ্গে শরীর থেকে বেড়িয়ে যায় টক্সিন নামক একটি পদার্থ। ভাল ঘুম ওষুধের থেকেও থেকেও ভালো কাজ করে।

ইনসমনিয়ার কারণ…

সাধারনত অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাই ইনসমনিয়ার মূল কারণ। ইদানীং তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ অনেক বেড়ে গেছে। প্রথম দিকে বিভিন্ন কারনে যেমন- ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, পড়াশোনা করা ইত্যাদি কারণে ঘুমে দেরি হয় এবং পরবর্তীতে সঠিক সময়ে আর ঘুম আসে না। এ ছাড়াও আরও বেশ কিছু কারণ আছে যা আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। যেমন-

  • ডিপ্রেশন বা অবসাদগ্রস্ত, টেনশন, দুঃস্বপ্ন ইত্যাদি ঘুমের ব্যঘাত ঘটাতে পারে।
  • অতিরিক্ত ক্যাফেইন পান, যেমন- চা, কফি ইত্যাদি উত্তেজক পদার্থ ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
  • নিয়মিত অ্যালকোহল গ্রহন করলে ঘুমের সমস্যা হতে পারে। প্রথম প্রথম অ্যালকোহল গ্রহন করলে ঘুমের সমস্যা না হলেও পরবর্তীতে নিয়মিত অ্যালকোহল গ্রহন করলে ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
  • ধূমপান বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য সেবন তরুণ সমাজের ইনসমনিয়ার একটি অন্যতম প্রধান কারণ।
  • মাংসপেশির সংকোচন ও পা নাচানো রোগের কারনে ঘুমের ব্যঘাত ঘটতে পারে।
  • যাদের নিয়মিত একস্থান থেকে অন্যস্থানে ভ্রমণ করতে হয়, তাদের ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
  • উচ্চরক্ত চাপ এবং কিছু কিছু রোগের কারণে মস্তিষ্কে রাসায়নিক দ্রব্যের তারতম্য ঘটলে ইনসমনিয়া হতে পারে।
  • কিছু কিছু ওষুধ সেবনের ফলে, যেমন- হাঁপানি রোগের ওষুধ সারাজীবন ধরে খেতে হয়। এতে ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
  • শারীরিক কিছু সমস্যায়, যেমন- আর্থাইটিস, বুকজ্বালা, মাথাব্যথা, দাঁতের সমস্যা, লিভার, ফুসফুস বা কিডনির সমস্যা, প্রোস্টেটের সমস্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনিদ্রা হতে পারে।
  • কাজের শিফট যদি এলোমেলো হয়, যেমন- একদিন দিনে আবার অন্যদিন রাতে। এরূপ ক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
  • আবার পরিবেশগত কারনে, যেমন- অতিরিক্ত কোলাহল, উচ্চস্বরে গান বাজানো, গাড়ির শব্দ ইত্যাদি কারনে ঘুমের সমস্যা হতে পারে।

সঠিকভাবে ঘুম না হলে কি হতে পারে?

সঠিকভাবে ঘুম না হলে অনেক সমস্যা হতে পারে। যেমন-

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হৃদরোগ, স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া, মাথাব্যথা, কোমরব্যথা ইত্যাদি।
  • ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
  • ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে।
  • দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পায় এবং মেজাজ খিটমিটে থাকে।
  • কাজের ওপর থেকে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

ইনসমনিয়ার লক্ষণ…

কিছু লক্ষণ দেখে অনুমান করা যায় যে, রোগী ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত। যেমন-

  • ঘুম দেরিতে আসা, পাতলা ঘুম হওয়া এমনকি বারবার ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
  • অনেক ক্ষেত্রে পর পর দুই-তিন রাত ঘুমোতে না পারা।
  • পড়াশোনা ও অন্য যেকোনো কাজে মনোযোগের অভাব।
  • মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকা।
  • মাঝেমধ্যেই মাথাব্যথা হওয়া।
  • অল্প কারনেই রেগে যাওয়া।
  • সামান্য পরিশ্রমেই ক্লান্তিবোধ হওয়া।

চিকিৎসা…

ঘুমের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা মনে হলে এবং সেটা নিয়মিতভাবে হতে থাকলে দেরি না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আপনার কি কি সমস্যা আছে, কেন ঘুম হচ্ছে না ইত্যাদি বিষয়ে চিকিৎসককে বিস্তারিত বলতে হবে, যাতে তিনি সহজে আপনার সমস্যা বুঝতে পারেন। অধিকাংশ ঘুমের সমস্যাই সাময়িক তাই নিজের প্রতি একটু বেশি যত্নবান হলে এই সমস্যাগুলো সহজেই কাটিয়ে উঠা সম্ভব।

কিছু নিয়মকানুন মেনে চলুন…

সঠিক চিকিৎসায় অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। একটু সচেতনতা, কিছু ভালো অভ্যাস এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে সহজেই এ সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়া যায়। যেমন-

  • প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় রুটিন করে বিছানায় যাওয়ার চেষ্টা করুন। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস করুন এবং একই সময়ে উঠুন। খেয়াল রাখবেন, শোয়ার সময় যেন রাত ১২টা পার না হয়।
  • ভরা পেটে বিছানায় গেলে অস্বস্তির কারণে ঘুম নাও আসতে পারে তাই ঘুমানোর কমপক্ষে ১ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার শেষ করুন।
  • রাত ৮টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করুন। রাতের খাবারে ভারী খাদ্য বর্জন করুন এবং এক গ্লাস দুধ রাখার চেষ্টা করুন।
  • ঘুমানোর আগে উষ্ণ গরম পানিতে গোসল করে নিতে পারেন।
  • নিয়মিত হাঁটা, জগিং, সাঁতার বা সাইকেল চালানো শরীরকে রিল্যাক্স করে গভীরভাবে ঘুমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ মিনিট হালকা ব্যায়ামই ভালো ঘুমের জন্য যথেষ্ট। ঘুমানোর পূর্বে দুই ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ব্যায়াম করবেন না।
  • বিছানায় অযথা শুয়ে না থেকে বিছানাটা শুধু ঘুমের জন্যই ব্যবহার করুন। ঘুম না এলে বিছানায় না শুয়ে থেকে বরং বই পড়ুন বা হাঁটাহাঁটি করুন। ঘুম না আসা পর্যন্ত বিছানায় যাবেন না।
  • ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে কোন দুশ্চিন্তা করবেন না। পরবর্তী দিনের পরিকল্পনা বিছানায় যাওয়ার আগেই মনে মনে সেরে নিন।
  • দিনেরবেলায় ঘুমানোর অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করুন।
  • রাতের শিফটের কাজ পারলে পরিবর্তন করে নিন।
  • ঘুমানোর জন্য হালকা পোশাক এবং কোলাহল মুক্ত ও অন্ধকার ঠাণ্ডা ঘর বেছে নিন।
  • ঘুম না আসলে মেডিটেশন বা প্রার্থনা করুন।
  • ঘুমানোর আগে যৌন উত্তেজক বা ভীতিকর কিছু দেখা বা চিন্তা না করাই ভাল। ঘুম না এলে উল্টো দিক থেকে ১০০ থেকে ১ পর্যন্ত গোনা শুরু করুন।
  • মাদকদ্রব্য, মদ্যপান বা ধূমপানের অভ্যাস থাকলে, তা ত্যাগ করুন।
  • অতিরিক্ত চা বা কফি এবং কোমল পানীয় পান করবেন না। বিকালে বা সন্ধ্যায় চা বা কফি গ্রহণ করবেন না।
  • উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

ঘুমের ওষুধ…

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ খাওয়া ঠিক না। কারন- ওষুধ দিয়ে লক্ষণটা কমানো গেলেও অনিদ্রার আসল কারণ দূর করা যায় না। আবার দীর্ঘদিন ঘুমের ওষুধ খেলে এক সময় ওষুধে উচ্চ সহনশীলতা তৈরি হয়। ওষুধ খাওয়াটা এক ধরনের অভ্যাসে পরিণত হয় এবং অনেক সময় ওষুধ খাওয়ার পরও কাজ করে না। সাধারনত রোগের ইতিহাসের ওপর ডাক্তাররা ঘুমের ওষুধ এবং এর পরিমাণ নির্ধারণ করে থাকেন। ঘুমের ওষুধ সাময়িকভাবে সেবনের প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খাওয়া যাবে না। কিছু ওষুধ আছে যেগুলো ইনসমনিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, যেমন- ফ্লুরাজেপাম, ক্লোনাজেপাম, ডায়াজিপাম, ব্রোমাজেপাম, মিডাজোলাম, এসজপিক্লোন, এন্টিডিপ্রেসেন্টস ইত্যাদি। তবে যেকোনো ওষুধ খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে।

সবশেষে…

অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া যেমন একটি বড় সমস্যা অপরদিকে চোখে ঘুম আনার বহু চিকিৎসা পদ্ধতিও আছে। তবে অনেক সময়ই এসব চিকিৎসায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। আবার এমন কিছু খাবার আছে যার মধ্যে ঘুম আনার উপাদান পাওয়া যায়। যেমন- পনিরের মধ্যে গভীর ঘুম এনে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। এর ট্রিপটোফান এমন এক অ্যামাইনো এসিড যা মেলাটনিন এবং সেরোটনিন উৎপন্ন করে যা ঘুম আনে। গরম এক গ্লাস দুধ দেহে দারুণ কাজ দিতে পারে। কারণ- এতে ট্রিপটোফান থাকে আবার দুধকে গরম করা হলে অ্যামাইনো এসিড থেকে বেশি পরিমাণ মেলাটনিন এবং সেরোটনিন উৎপন্ন হবে এবং ঘুম আরো গভীরভাবে আসবে। আলু সেদ্ধ করা হলে এটা থেকে কিছু ইনসুলিন ঝরে যায় এবং কিছু পরিমাণ অ্যামাইনো এসিড ট্রিপটোফানের সঙ্গে বিক্রিয়া করে রক্ত ও পেশির কোষে মিশে যায়। আলু, পাস্তা এবং রুটিতে ঘুমের উপাদান আছে। ভ্যালেরিয়ান গাছের শেঁকড়চূর্ণ মহৌষধের মতো কাজ করতে পারে। অনেক আগে থেকেই এটি দেহ ও মনকে স্থিত করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যদিও এর কার্যকারিতা নিয়ে বৈজ্ঞানীক কোন ব্যাখ্যা নেই, কিন্তু অনেক আগে থেকেই ঘুমের সমস্যাজনিত কারণে এটি ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, নিয়মিত ব্যয়াম বা শারীরিক পরিশ্রম, খাবারে একটু সচেতন হলে এবং প্রতিদিনের জীবনযাপনে সামান্য কিছু পরিবর্তন করে খুব সহজেই অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া প্রতিরোধ করা যায়।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *