ভুবনবিখ্যাত গুহাচিত্রের সন্ধানে “অজিণ্ঠায়”

ajintha-cave
                অজিণ্ঠার গুহা

জায়গাটার নাম ‘ভিউ পয়েন্ট’৷ পাহাড়ি প্রায় সব জায়গাতেই এমন এক একটি ‘ভিউ পয়েন্ট’ থাকে। তাই প্রথমটায় আমাদের গাড়ির চালক যখন বললেন, ফরদাপুর থেকে প্রথমেই আমরা ভিউ পয়েন্টে যাব, তেমন কিছু মনে হয়নি।

অজিণ্ঠা দেখতে এসে উঠেছি মহারাষ্ট্র পর্যটন উন্নয়ন নিগমের ফরদাপুর টুরিস্ট রিসর্টে। সেখান থেকেই আমাদের প্রথম যাত্রা ২৩ কিলোমিটার দূরের ভিউ পয়েন্টের উদ্দ্যশ্যে। আওরঙ্গাবাদ-জলগাঁও রোড ধরে মিনিট পঁচিশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম৷ গিয়ে গাড়ি থেকে নেমেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আধখানা চাঁদের মতো একটা পাহাড়ি বাঁক ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে, আর ওই পাহাড়ের গা কেটেই তৈরি হয়েছে অজিণ্ঠার ভুবনবিখ্যাত তিরিশটা গুহা৷ দুশো বছর আগে, ঠিক এই জায়গাটি থেকেই একদল ইংরেজ সেনা-অফিসার শিকার করতে গিয়ে ঘন জঙ্গলের গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পান নদীর ও পারে পাহাড়ের গায়ে সারি সারি খিলান আর স্তম্ভ। আবিষ্কৃত হয় অজিণ্ঠা.!

সাধারণত এই ‘ভিউ পয়েন্ট’ থেকে অজিণ্ঠার গুহার দিকে কম পর্যটকই যান৷ অজিণ্ঠার গুহা-চত্বরে ঢোকার জনপ্রিয় পথ হল মহারাষ্ট্র পর্যটন উন্নয়ন নিগমের অজিণ্ঠা টি জংশন থেকে চার কিলোমিটার পথ উঠে এক নম্বর গুহার সামনের গেট দিয়ে ঢোকা। এ পথে অজিণ্ঠা গুহায় যাওয়ার জন্যই সরকারি বাস চলে সারা দিন৷ ভাড়া জনপ্রতি কুড়ি টাকা৷ কিন্তু বাস যেখানে নামিয়ে দেয় সেখান থেকেও সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ে উঠতে হয় অনেকটা৷ সঙ্গে একটা গাড়ি থাকলে ভিউ পয়েন্ট থেকে নেমে আট নম্বর গুহার সামনের গেট দিয়ে গুহা-চত্বরে ঢোকাই ভাল৷ নামার জন্য সুন্দর রেলিং দেওয়া বাঁধানো সিঁড়ি আছে৷ বগোড়া নদী পেরোবার জন্য সেতুটিও যথেষ্ট ভাল৷ আট নম্বর গুহার গেটেও আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার টিকিট কাউন্টার আছে।

ajintha-model
                             ক্ষয়িষ্ণু, উজ্জ্বল অজিণ্ঠার সেই নিদর্শন

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী, প্রায় ন’শো বছর জুড়ে অজিণ্ঠার গুহাগুলি তৈরি আর তার ভিতরে ছবি আঁকা হয়েছে৷ তার পরে প্রায় এগারোশো বছর গুহাগুলি ছিল অজ্ঞাতবাসে৷ তার পরে যখন দুশো বছর আগে আবিষ্কৃত হল তখনও প্রায় কুড়িটা গুহার ভেতরে ছবিগুলি অক্ষত ছিল৷ তার পরে এই দুশো বছরে নষ্ট হতে হতে সংখ্যাটা নেমেছে ছ’য়ে৷

তবু যেটুকু আছে তা আজও যেন কথা বলে৷ মোট তিরিশটা গুহার মধ্যে পাঁচটি (৯, ১০, ১৯, ২৬, ২৯) চৈত্য-গৃহ, বাকি পঁচিশটি সঙ্ঘারাম বা বিহার৷ বৌদ্ধদের উপাসনার জায়গাকে চৈত্য-গৃহ বলা হয়, এবং  থাকার জায়গাকে সঙ্ঘারাম বা বিহার৷ আর এই গুহাগুলির ভেতরে দেওয়ালের গায়ে, থামের গায়ে আঁকা আছে অসাধারণ সব ম্যুরাল৷ বেশ কয়েকটি গুহার বাইরে এবং ভেতরে আছে বুদ্ধের নানা মুদ্রার মূর্তি৷ অনুমান করা হয়, বুদ্ধের মূর্তিগুলি পরবর্তী যুগের, মহাযান বৌদ্ধধর্মের সময়কার৷ কারণ, তার আগের হীনযান পন্থার বৌদ্ধরা মূর্তিপুজোয় বিশ্বাস করতেন না৷

গুহাগুলোর ক্রমিক নম্বর কিন্তু কেবল দেখার সুবিধের জন্য, গুহানির্মাণের সময়ের সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই৷ খ্রিস্টের জন্মের দুশো বছর পূর্ব থেকে দুশো বছর পরে, মোটামুটি এই চারশো বছরে তৈরি হয়েছিল ১০, ৯, ৮, ১২, ১৩, ৩০  এই ছ’টি গুহা৷ বাকিগুলি পরবর্তী সময়ের৷ এ কথাটা মনে রাখলে গুহাগুলি দেখতে সুবিধে হবে৷ যেমন, এক নম্বর গুহাটি অনেক পরের, ৬০০ থেকে ৬৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, চালুক্য রাজাদের আমলে তৈরি৷

গুহার গায়ের ছবিগুলোর প্রায় সব ক’টি জাতকের কাহিনি নিয়ে৷ অজিণ্ঠা যাওয়ার পরিকল্পনা করার সময়েই তাই জাতকের গল্প পড়তে শুরু করেছিলাম৷ ছবিগুলো দেখতে দেখতে মনে পড়তে লাগল সেই পড়া গল্পগুলো৷ যেমন, এক নম্বর গুহার দেওয়ালে শঙ্খপাল জাতকের গল্প৷ তেমনই আরও আছে, মহাজনক জাতক, শিবি জাতক, চম্প্যেয় জাতক…৷ গল্পগুলো না পড়ে গেলে ছবিগুলো দেখার তেমন মানে থাকবে না৷

ajintha-tourist-area
                               “অজিন্ঠা” পর্যটন এলাকা

অজিণ্ঠার সব ক’টি গুহা খুব ভাল করে দেখতে গেলে অন্তত দু’দিন হাতে রাখা দরকার৷ সে ক্ষেত্রে ফরদাপুরে না থেকে টি জাংশনে থাকাই ভাল৷ রিসর্টের প্রায় সামনে থেকে সে ক্ষেত্রে বাস ধরা যাবে গুহায় যাওয়ার জন্য৷ বাসস্ট্যান্ডের সামনে নানা রকম হস্তশিল্পের বাজারও আছে৷ অবশ্য আমাদের হাতিবাগানের প্রায় দ্বিগুণ উৎসাহে দরদস্তুর করতে না পারলে ঠকে যাওয়ার আশঙ্কা। আর একটা কথা, টি জাংশনে থাকলে বিকেলের পরেই চারিদিক শুনশান হয়ে যাবে, বিশেষ কিছু করার থাকবে না৷ যদি সব গুহা দেখার সময় না থাকে, অন্তত এই কটা দেখতেই হবে- ১, ২, ৯, ১০, ১৬, ১৭, ১৯, ২৬।

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *