স্বপ্ন দেখি সুন্দর পৃথিবীর….১

বার বার চেষ্টা করেও বইয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারছিল না আরভ। চোখ চলে যাচ্ছিলো সামনের সীটে বসে থাকা স্বাতির উপর। ট্রেন ছাড়ার পর থেকে গত দেড় ঘন্টায় এক মূহুর্তেও জন্য কথা বলায় বিরতি দেয়নি মেয়েটি। ক্রমাগত একজনের পর আরেকজনের সাথে ফোনে কথা বলেই যাচ্ছে। এই হাসছে, এই কাঁদছে, এই অভিমান করছে, শঙ্কিত হচ্ছে আবার পর মূহুর্তেই নিজেই কাউকে আশ্বস্ত করছে। চোখের সামনে এইসব কর্মকান্ড চলতে দেখলে বইয়ের দিকে মন দেয়াটা কষ্টকরই বটে। হাতের বই বন্ধ করে সীটে একটু হেলান দিয়ে বসে ভালো মত তাকালো স্বাতির দিকে। খুবই সাধারণ একটি সুতির থ্রিপিস পড়েছে। দু’হাতে মেহেদির আল্পনা ছাড়া আর কোন গহনা বা প্রসাধনীর চিহ্ন নেই কোথাও। তবে লাল টুকটুকে ওড়নাটা মাথায় তুলে দেয়ার কারণে নববধূর মত লাগছে মেয়েটিকে। কার সাথে যেন কথা বলতে বলতে হেসে ফেললো স্বাতি। সাথে সাথে আরভের মনেহলো এমন হাসি যাকে আল্লাহ দিয়েছেন কোন কৃত্রিম প্রসাধনীর প্রয়োজন তার নেই! আরভের সাথে চোখাচোখি হলে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে তুললো স্বাতি। আরভ চোখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের তাকালো। ছুটে চলছে ট্রেন গন্তব্য পানে! অসুস্থতার কারণে বড় ফুপি আরভ ও স্বাতির বিয়েতে অংশগ্রহণ করতে পারেনেনি। এখনো ভীষণ অসুস্থ ফুপি। তাই পরিবারের অন্যান্যরা সবাই ঢাকা রওনা দিলেও স্বাতি আর আরভ চিটাগাং যাচ্ছে বড় ফুপির বাড়িতে। স্বাতি ট্রেনে যাবার বায়না ধরাতে আরভ আর আপত্তি করেনি।

দৃষ্টি বাইরে থাকলেও তার সহযাত্রীনি এত কি কথা বলছে সেটা শোনার চেষ্টা করলো আরভ। ফোনে বাবাকে বলছে, শোন নিয়মিত মেডিসিন নিতে যেন ভুল না হয়। মেডিসিন নেয়ার পর আমাকে ম্যাসেজ লিখে জানিয়ে দেবে মেডিসিন নিয়েছো। আর কোন কাজেই যেন অনিয়ম না হয় বলে দিচ্ছি। উল্টো পাল্টা হলে কিন্তু আমি ফিরে এসে তোমাকে কঠিন শাস্তি দেব সেটাও বলে রাখছি। আরেকটা কথা মামণির দিকেও কিন্তু খেয়াল রাখবে। দুজন মিলে কান্নাকাটি করবে না একদম। যদি আমি টের পাই তোমরা কান্না করেছো! তাহলে কিন্তু আমিও কান্না করবো বলে রাখছি। বলো তুমি চাও আমি কান্না করি? হুম! এমন আমিও চাই না তোমরা দুজন কান্না করো বুঝেছো?! আর তুমি এতক্ষণ ওয়াশরুমে কি করছিলে? যদি আমার সেলফোনের চার্জ শেষ হয়ে যেত তাহলে তোমার সাথে কথা বলতাম কিভাবে? সময়ের মূল্য ওয়াশরুমে গিয়ে ভুলে গেলে চলবে? আবার হাসো কেন তুমি? সেলফোনের চার্জ নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি তিনটা মোবাইল ভর্তি করে চার্জ নিয়ে এসেছি। একটার চার্জ শেষ হলে আরেকটা দিয়ে কথা বললো। আরভের একবার বলতে ইচ্ছে করলো, তিনটা মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেলেও চিন্তার কিছু নেই। আমার কাছে যেটা আছে সেটা লোন দিতে কোনই আপত্তি নেই আমার। কিন্তু ইচ্ছেটা গোপন করে আবারো কথা শোনাতে মন দিলো। এখনো বাবাকে ধমকাচ্ছে তার স্বাতি কেন ওয়াশরুমে এতক্ষণ ছিল। বলে দিচ্ছে সর্বোচ্চ বিশ মিনিট থাকা যাবে ওয়াশরুমে।

কেমন যেন একটা সুখ সুখ আবেশ ছেয়ে গেলো আরভের মনের মাঝে। সব মেয়েরাই কি এমন অদ্ভুত রকমের আদুরে হয়?! আল্লাহ চাইলে তার নিজের যদি কখনো মেয়ে হয় সেই মেয়েটি কি স্বাতির মতোই আদুরে হবে? এমন ধমকের সুরে ওয়াশরুমে কতক্ষণ থাকবে সেটাও নির্ধারণ করে দেবে?!

বাড়ির সবার সাথে ফোনে কথা বলা শেষ করে আরভের দিকে তাকালো স্বাতি। গভীর মনোযোগ দিয়ে লিখছে কি যেন। একদম মুখোমুখি বসেছে সে তাই দেখার উপায় নেই কি লিখছেন উনি। এত মনোযোগ দিয়ে কি লিখছে? লেখা দেখতে ব্যর্থ হয়ে লেখকের দিকেই তাকালো! চেহারার মধ্যে কি অদ্ভুত আত্মনিমগ্নতা ছড়িয়ে গিয়েছে মানুষটার! মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। খুব ইচ্ছে করতে লাগলো পাশে গিয়ে বসতে। কিন্তু নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে সে। অকারণেই তর্ক জুড়ে দিয়েছিল ট্রেনে উঠার পর। দুষ্টুমির ছলে সেটা যে সিরিয়াস পর্যায়ে চলে যাবে মোটেই বুঝতে পারেনি। কথায় কথায় আরভকে বলে ফেলেছিল, তোমাকে বিয়ে করাই আমার ঠিক হয়নি। বাক্যেটি শোনা মাত্র দপ করে নিভে গিয়েছিল আরভের চেহারার আলো। শক্ত হয়ে গিয়েছিল চোখ মুখ। স্বাতি কিছু বলার আগেই কঠিন স্বরে বলেছিল, পুরো জার্নিতে তুমি আমার সাথে কোন কথা বলবে না। না আমি তোমাকে চিনি, না তুমি আমাকে চেনো। এরপর হাজারটা কথা বলেছে, অসংখ্যবার সরি বলেছে কিন্তু আরভের মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের করাতে পারেনি। এজন্যই ফোনে কথা বলে কান ঝালাপালা করে দেবার চেষ্টা করেছে। যাতে বিরক্ত হয়ে কিছু বলে আরভ। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। বই পড়ছে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকছে, এখন লিখতে বসেছে। কিন্তু কথা তো দূরে থাক একটা শব্দ পর্যন্ত বের করছে না মুখ দিয়ে বান্দাহ। এত কঠোর মানুষ হয়? কিভাবে এই লোকের সাথে সারাজীবন কাটাবে ভেবে কিছুটা শঙ্কিত বোধ করলো স্বাতি।

চলবে….

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *