একখণ্ড হিরার অপমৃত্যু

একখণ্ড হিরার অপমৃত্যু

এলাকার সবাই তারে ডাকে হিরার বাপ বলে। আসল নামটা কবে যে মাটিচাপা পড়ে গেছে মনে করতে পারে না আবুল ফজল। এইসব নামধাম, হাবিজাবি নিয়ে তার বিশেষ কোন মাথা ব্যথাও নেই। যার যা ভাল লাগে তাই বলে ডাকবে। ক্ষতি তো নেই। এই মহল্লায় সব গরীব লেকের বাস। ধনীলোক বলতে ঐ একঘর, লস্কর সাহেব আর তার বংশবনেদ। আর সব ছন্নছাড়া, ধরা যায় ফকিন্নির ঘরের ফকির। আবুল ফজলও প্রায় তাই, তবে ওদের ভিতরে সে একটু ভাল। দুই মেয়ে, এক ছেলে আর তারা মিয়াবিবি মিলে মোট পাঁচজনের সংসার তার রেলওয়ের ছোট্ট একটা চাকরিতে দাঁড়িয়ে আছে অশীতিপর বৃদ্ধের হাতের জীর্ণ পাঁচ আঙ্গুলের মতন। এই মহল্লায় কেউ যেমন তারে ভক্তিশ্রদ্ধা দেখায় না, তেমনি উষ্ঠা-চড়ও মারে না। যার যার মতন আছে সবাই, কেটে যায় নিজেকে নিয়ে। মনে হয় এই কারণে মানুষে গিজগিজ করা এই মহল্লায় তার নিজেরে বড্ড একা লাগে। তবে ঘরে গেলে সেসব কিছু কেটে যায়। হাজার সমস্যায় টুটাফাঁটা তার ঘরখানা যেন স্বর্গের একটুকরো বাগান।

আজকে হিরার মেট্রিকের রেজাল্ট বেরোবার কথা। হিরার বাপ দুইদিন আগে মরণচাঁদের দুই কেজি মিষ্টি এনে ফ্রিজে লুকিয়ে রেখেছে। কেউ জানেনা। সবাইকে অবাক করে দিবে সে। তার ধারণা আছে, তার ছেলে সাংঘাতিক রকমের কিছু একটা সুখবর দেবে আজকে। ছেলে হয়েছে তার মতন তাগড়া জোয়ান। দেখলে কেউ বলবে না সতেরো বছর বয়স তার। একটু সকাল সকাল অফিস সেরে বসার ঘরের রঙচটা সেফাটায় বসে ঝিমুচ্ছিলো আবুল ফজল। ছেলে কখন এসে তার পাশে দাড়িয়েছে খেয়াল করেনি সে। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে দেখে সামনে দাড়িয়ে হিরা।

-কিরে তোর রেজাল্টের খবর কি?

-আব্বা আমি গোল্ডেন জিপিএ পাইছি। স্কুলে আর কেউ পায়নি। আমি একা।

এমনভাবে খবরটা সে দিল, যেন গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে সে মস্ত অন্যায় করে ফেলেছে।

-নে হা কর, একটা মিষ্টি খা। আর এই প্যাকেটটা নিয়ে যা বাসার সবার মুখে মিষ্টি দিয়ে দে।

পাশে গামছা দিয়ে ঢেকে রাখা মিষ্টির প্যকেট থেকে একটা মিষ্টি বের করে ছেলের মুখে দেয় আবুল ফজল। নিজেও একটা খায়।

-আর হ্যা, ঐ যে তোর সাথে পড়ে লস্কর সাহেবের ছোট পোলা রুবেল, হ্যায় কেমুন করছে?

-হ্যায় আব্বা কুনো মতে পাশ করছে। এত ডাকলাম, আমার সাথে একটা কথাও কইলো না আব্বা।

– গাধা পোলাডা। হেয় তো তিন তিনবার পরীক্ষা দিয়া পাশ করছে। থাক বাজান মন খারপ কইরো না, যাও।

তার ছেলেটা ভিষণ শান্ত স্বভাবের। এত বড় শরীর, দেখলে গুণ্ডাপাণ্ডা মনে হলেও হতে পারে। বড্ড নিরীহ। আসল হিরার টুকরা সে। না খেয়ে হলেও সে হিরাকে ডাক্তার বানাবে। অবশ্যই বানাবে।

সময় গড়িয়ে যায়। তার কাজই গড়িয়ে গড়িয়ে চলা। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা তার স্বভাবে নেই। তাকে একেক জন একেক ভাবে চেনে। কেউ চেনে মহান হিসাবে, কেউ চেনে নীচ, খল হিসবে। এর একটা কারণ বোধ হয়, সময় নানান ঘটনা ঘটানোয় পটীয়সী। সময় একদিন হঠাৎ আবুল ফজল ওরফে হিরার বাপের সামনে এসে দাড়ায় খল নায়কের সাজে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। একদিন সন্ধ্যায় পুলিশ রেট করে হিরার বাপের বাসা। জরাজীর্ণ মলিন বিল্ডিংটা ঘিরে ফেলে তারা। চেক হবে বাসা। ওয়ারেণ্ট আছে। বাসা তল্লাশী করে ফ্রিজের মাথার উপরে প্রায় এককেজি ওজনের একটা টোপলা পাওয়া গেল। টোপলায় কোকেন। তারপরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। গ্রেফতার হয়ে থানায় চলে যায় আবুল ফজল। কারও কান্নাকাটিতে পাথর গলে না। আধুনিক পুলিশ। পুলিশের কাজ দেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা। তারা তাই করছে মাত্র।

সেদিন সারা রাত আবুল ফজলের জীর্ণ বাসাটিতে চারটা প্রাণীর চোখের দুই পাতা এক হলো না। পেটে কারও দানাপানিও পড়লো না। অপেক্ষার আঠারো ঘণ্টা কেটে গেল যেন আঠারো বছরের প্রশস্ততায়। থানা থেকে পরদিন দুপুরের দিকে ফোন এলো ডেড বডি নিয়ে যাবার জন্যে। চারটা প্রাণী পাথর হয়ে গেল যেন। তারা কাঁদতে ভুলে গেল। তারা কেউ জানতো না প্রতিবাদ কিভাবে করতে হবে, বা আদৌ করতে হবে কিনা। তাদের সামনে ঠিক ঐ সময়ে দুটো মূর্তিমান অস্তিত্ব খাড়া হয়ে দাড়িয়ে গেল। এক- আবুল ফজলের শোক, দুই- ক্ষুধা। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি আর নেই। তার দায়িত্বটা নেয়ার মতন কেউ নেই, কলেজে পড়া হিরা ছাড়া। তার ইণ্টার পড়া মাঝপথে শেষ হলো। ডাক্তার হবার সকল সম্ভাবনাকে পাশে রেখে সে সংসারের ভারটা তার চওড়া কাঁধে তুলে নিলো। মহল্লার মানুষ একসময় ভুলে গেল, তাদের এলাকায় হিরার বাপ বলে একটা লোক ছিল। একটু একটু করে আবুল ফজলের আটপৌরে স্মৃতিটা ফিঁকে হয়ে গেলো তার পরিবারের বেঁচে থাকা সদস্যদের কাছেও। কারণ ঐ ঘরে ক্ষুধা আর সময় একসাথে বাসা বেঁধেছে যে। সময় এমনই। সে অঘটন ঘটন পটীয়সী।

হিরা এখন চাকরী করে। তবে তার কাজের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। মাঝেমাঝে এক নাগাড়ে সাতদিন, পনেরো দিন বাড়িতে আসা হয় না তার। টাকা দিয়ে দেয়, মা-ই সব দেখাশুনা করে। মা তার উপরে বেজায় খুশি। তার ছেলে ভীষণ নামাজি হয়েছে। দাড়ি রেখেছে, বাহারী দাড়ি। তবে জুব্বা জাব্বা পরে না তার হিরা। ছেলে তার মোটামুটি রোজগেরে। এবার দেখেশুনে একটা ভাল বিয়ে দিতে পারলে মায়ের মন জুড়ায়। মায়ের মন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

হিরা বাড়িতে নেই। কাজে গেছে। আজকে এই সময় এমন লাগছে কেন হিরার মার? এই তো গতবারও তো হিরা চাকরীর জন্যে সতেরো দিন বাড়ি আসেনি। এইবার তো মাত্র ছয়দিন হলো ছেলে তার কাজে গেছে। এমন লাগছে কেন তার? একবার এঘরে, আরেকবার ওঘরে, কখনও ছাদে, কখনও বা নীচে, এই ভাবে অস্থির পায়চারী কেন তার? এখন রাত আটটা। সময় কি নতুন কিছু উপহার দিতে চায় এই পরিবারে? এই পরিবারে কি শনির দৃষ্টি পড়েছে? মায়ের মন তড়পায়। হে কাল, মহাকাল, তুমি এমন কিছু দিও না, যা এই তিনটা প্রাণীর সহ্য করার ক্ষমতা নেই।

টেবিলের উপরে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠে। একটা বড় ছুরি যেন মায়ের হৃদপিণ্ডে এফোঁড় ওফোঁড় হলো। ফোন ধরলো হিরার মা।

-বাজান হিরা, তুমি কই?

-মা আমি………।

ফোনের ওপাশে হালকা কান্নার শব্দ।

-বাজান তুমি কানতেছো যে! কী হইছে?

ফোনের ওপার থেকে শোনা যাচ্ছে সব। কে একজন ঠেলে ঠেলে হিরাকে নিয়ে যাচ্ছে। ঐ তো হিরার গলা- তুই র‍্যাব? রুবেল? আমারে মারিস না। আমারে মারিস না। রুবেলের গলা শুনা যায়- গজ গজ করে হিরার কানের কাছে মুখ এনে বলছে- গোল্ডেন জিপিএ চো*ইছে। শালার জঙ্গীর জঙ্গী।

-হেলো মা, আমি হিরা রুবেল জঙ্গী র‍্যাব…। আমি কিছু করি নাই মা—-।

মোবাইল ফোনটা অন করে রুবেলের পকেটে রাখা। ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে হিরার হালকা কান্নার শব্দ। আশপাশে লোকের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর। তার বলছে- এই জঙ্গীটা সেইটা তো? সব ঠিক আছে তো?

পরপর দুটো গুলির তীব্র শব্দ হয়। গলায় ছুরি চালানো কোরবানীর পশুর গর্জনের মতন চাঁপা গর্জন শুনে একটা মরণ চিৎকার দিয়ে হিরার মা বেহুশ হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। পাশে দাড়িয়ে কান্নারত দুইবোন ফোন তুলে ওপারে শুনতে পায় আরও গুলির শব্দ, আরও চাপা গর্জন। দুই বোন একসাথে চিৎকার করে।

-এই আপনারা কে? আপনারা কে? আমার ভাই কিছু করে নাই। আমার ভাই নিষ্পাপ। আমার ভাই কিছু করে নাই যে। আপনারা তারে ছাইরা দেন। তারে ছাইরা দেন।

তাদের কণ্ঠে কান্না, প্রতিরোধ, ভয়, ঘৃণা সব। তাদের চিৎকার একই সাথে সারা দেশের মানুষ শোনে, কিন্তু স্থির করতে পারে না হিরার কি দোষ, বিচারই বা করার কথা কার?

চিৎকার করতে করতে দুই বোনই বেহুশ হয়ে পড়ে যায় মেঝেতে। সাথে সাথে চারদিক দখল করে নেয় মৃতপুরির নীরবতা। এই মুহুর্তে ঘরে চেতনা সাথে নিয়ে জীবিত প্রাণীর মতন আর কেউ নেই, যে প্রতিবাদ করে বলতে পারে, তোমরা অন্যায় করেছ, তোমরা পাপ করেছ, তোমরা একটা মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করেছ। সম্ভবতঃ সারা দেশেও এমন কথা বলার মতন আর কেউ নেই।কারণ দৃশ্যমান ঈশ্বর ভয়ংকর নিকৃষ্ট ও ক্ষমাহীন হয়।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *