“আমার মৃত্তিকা”.!

“আমার মৃত্তিকা”

–মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম আলফি,
লেখক ও ব্লগার

সময়টা তখন ভোর ৬:১০। শীতকালীন মৌসুমে বাবার সঙ্গে মাঠে যাচ্ছে ১০ বছরের কিশোর মিটুু। মিটু খুব দুুষ্ট, চন্ঞল ও মিশক টাইপের পাজি ছেলে। সবে ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র। গরীব ঘরের গ্রামের হাওয়া বাতাস গায়ে লাগানো এক কিশোর।

বাবা অন্যজমিতে ইজারা হিসেবে কাজ করে সংসারের ভরণপোষণ চালান। শীতের ছুটিতে বাবাকে সাহায্য করতে সেইদিন মিটুও যায় মাঠে।
বাবার স্বপ্ন ছেলে বড় হলে ডাক্তার বা ইন্জিনিয়ার হবে। কিন্তু বাবা চিন্তিত ছেলে যে পাজি, ওর দ্বারা কি সম্ভব। তবে, বুঝালে ছেলেটা কিছু বুঝে তাই মিটু বাবা একটু স্বস্তী পান।সেই দিন ভোরে কাজ শেষে মিটু বাবার সঙ্গে বিকালের শেষে হাটে বাজারে যায়। উদ্দেশ্য কিছু কাঁচা বাজার কিনে নেওয়া। হাটেই একটা গরুর বাছুর দেখতে পায় মিটু। বয়স ২মাস মত। বিক্রেতা টাকার জন্য বাছুরটি ৩৫০০ বিক্রি করতে চায়। মিটুর কাছে খুব আদুরে লাগে গরুর ফুটফুটে বাছুটি। মিটু বায়না ধরে কান্নাকাটি ভাবে বাবাকে আবদার করে ” বাবা, বাবা, গরুর বাছুরটি আমার চাই”। বাবা বলল, “আমরাতো কখনও পালিনি গরুর খামার,, কি করবো”। মিটু বলল, “বাবা,আমার বয়সী পাড়ায় তো কেউ নেই, বাছুরকে নিয়ে খেলবো”।

মিটুর বাবারও একমাত্র ছেলের দাবি মেটাতে দর কষাকষি করতে করতে ৩০০০ টাকায় বাছুরটি ক্রয় করলো। শেষমেষ মিটুও খুব আনন্দে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো “বাবা, আমার তো ভাই নেই, আজ হতে ও আমার ভাই”
বাবা মুচকি হেঁসে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে ও তোর ভাই, কিন্তু নাম কি দেওয়া যায়?” তখন মিটু বলল, ” বাবা, আজ হতে যেহেতু ও আমার ভাই,তাহলে ওর নাম হচ্ছে “মৃত্তিকা”।
বাবা বলল, “বাহ্ সুন্দর নাম তো, মিটু হতে মৃত্তিকা।

এভাবেই মৃত্তিকাকে নিয়ে মিটুর কৈশোর জীবনে চলতে লাগলো। মিটুও বড় হতে লাগলো। বয়সের বাড়ে মিটুর বাবাও আগের মত ইজারা হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ পায় না। বল, শক্তি যে কমে গেছে মিটুর বাবার। ঐদিকে মিটুর সঙ্গে সঙ্গে মৃত্তিকাও খুব সুন্দর ও সুশ্রী হওয়াতে কুরবানী পশু হিসেবে অনেকেই টাকার খনি হয়ে প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মিটুর মা সম্মতি থাকলেও মিটু ও তার বাবা রাজি ছিল না কারণ, তারা মৃত্তিকাকে তাদের পরিবারের একজন সদস্য ভাবে, পশু নয়।

ঐদিকে মিটুও মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। বাবা বয়সের জোরে অক্ষম হওয়ায় অন্যের জমিতে কাজ ও রাতে ২টা টিউশনি চালিয়ে পরিবার টানতে থাকে। মিটুরও মা অন্য বাড়িতে কাজ করে আয় করছে। এত দুঃখ, দূর্দশা, অভাবের পরও মিটু মৃত্তিকার খেয়াল রাখে, যত্ন নেয়, মৃত্তিকার দিকে তাকালেই সে কস্ট সব ভুলে যায়।

এক কথায় রক্তের বাঁধনে যেন আবদ্ধ মিটু মৃত্তিকা জুটি। মাঝে মাঝে তো ভালবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে বলে মৃত্তিকা যদি মানুষরুপে আমার বোন হন তবে তোকে কখনও শ্বশুর বাড়ি পাঠাতাম না, দরকার হলে তোর স্বামীকে ঘরজামাই করে রাখতাম।

এ যেন রক্তের সম্পর্ক দেয়। অনেক ধনাঢ্য পরিবার মৃত্তিকাকে ক্রয় করার জন্য আগ্রহ দেখায়। অনেকে বলে, “মিটু, তোরা তো গরীব, তুই যদি গরুটা বিক্রি করছচ, লাখ টাকার উপর পাবি,এরকম আরও বাছুর পাবি, খামার করতে পারবি, স্বাবলম্বী হবি”।

নাছোর বান্দা মিটু মায়ার বাঁধন ছাড়তে চায় না,,
সে মৃত্তিকার সাথে বাকি জীবন কাটাতে চায়।
দেখতে দেখতে মিটু উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে গন্ডি পার হলো।
শুরু হলো আরও অভাব, সমস্যা। মিটু বাবার অবস্হা খুব খারাপ।
শ্বাস নিতে কস্ট হয়, অল্প জমা টাকা ছিল মিটুর।
মিটু বাবাকে ডাক্তার কাছে নিয়ে যেতে বলল মাকে। সন্ধ্যায় মিটু মৃত্তিকাকে খামারে বেঁধে ঘরে এসে বাবার অসুস্হতার কথা মাকে জিজ্ঞাসা করলো। মা চুপ রইলেন, বাবাও ঘুমিয়ে আছেন।
তখন “মা” অশ্রসিক্ত কন্ঠে মিটুকে জিজ্ঞাসা করে “মিটু তুই আমাদের কতটুকু ভালবাসোস?”

শুনে মিটু হতবম্ভ হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল আর চিন্তা করতে লাগলো বাবার খারাপ কিছু হই নি তো। সেই রাতে মিটু ঘুমাতে পারলো না। ভোরে উঠে ফজরের সালাত পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো বাবার সুস্হতার জন্য। সালাত শেষে বাবার কাছে এসে বসলো, বাবা কান্নায় বালিশ ভেজা ভেজা। মিটু বাবাকে জিজ্ঞাসা করতেই মা বলল,”তোর বাবার কিডনি একটা নস্ট হয়ে গেছে,তোর বাবা আর বাঁচবে না”।
মৃত্তিকা পশু হলেও সেও তাদের সবার অশ্রসিক্ত চোখ দেখে নিজেও কান্না করে দিল চোখের জলে।

মিটু খুব ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ডক্টর কাছে গিয়ে এর চিকিৎসা জানতে গেলে বলে ওনার অপারেশন খরচ + কিডনি সহ ২-৩লাখ টাকার প্রয়োজন। সে অবাক ও চিন্তা করে এত টাকা পাবে কোথায়, কে দিবে?
সে বাসায় এসে বাবাকে জানায় বাবা তোমার চিকিৎসা জন্য আমার একটা কিডনী ও আমাদের ভিটা বিক্রি করবো। বাবা বলে, “নারে বাবা, আমি আর কয়দিন বাঁচমু, তোরও ভবিষ্যত আছে, তুই ই
ড্ক্টর হইয়া সবার সেবা করবি স্বপ্ন আমাদের”। মিটু-” না, বাবা,তোমরা না থাকলে আমার কি হবে?

সময়টা তখন কুরবানী উৎসব। ডক্টর সঙ্গে পরামর্শ করে মিটু ২,৫০,০০০ লাখ টাকা জোগাড় করতে গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গে কাছে যায় জায়গা দলিল বন্ধক রাখতে। কিন্তু তারা বলে, “মিটু তোমার যে জায়গার দাম,তা ১,৫০,০০০ লাখও জায়না, তবে তোমার প্রিয় পশু “মৃত্তিকা” জন্য ৩,০০,০০০ দিব যদি তুমি চাও বিক্রি করতে”।
তখন দুঃখে ভরাকন্ঠে সে বলে “আমার জান যাবে, তারপরও মৃত্তিকাকে দিব না”। তখন অট্টহাসিতে ঐ ধনাঢ্য ব্যক্তি বলে উঠল “বাবার জীবনের চাইতেও কী,সামান্য একটা পশুর দাম তোমার কাছে বেশী?”

তখন বাস্তবতাকে সামনে এনে রাতে মৃত্তিকাকে জড়িয়ে কান্না করে সেই রাতে মিটু ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে “মাকে’- বলল “মা, তুমি একদিন জানতে চেয়ে ছিলে তোমাদের কেমন ভালবাসি, তবে শুনো, আমার এই বুক যদি ছিঁড়ে যদি দেখানো যেত তবে ডানপাশে তোমাদের নাম আর বামপাশে মৃত্তিকার নাম দেখতে পারতা”। বাবার চিকিৎসা জন্য আদরের মৃত্তিকাকে ৩লাখে ঐ ধনাঢ্য পরিবার কাছে বিক্রি করে দেয়। বিদায় বেলায়, মৃত্তিকার মাথায় জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো “ক্ষমা করে দিস মৃত্তিকা, আমার মৃত্তিকা”।

মিটু ঐ পরিবারের প্রতি বিনীত আবেদন করে বলে “মৃত্তিকাকে যত্ন করবেন, ও পশু বলে অন্যায়ভাবে বেদরক মারবেন না, ওকে জবাইয়ের সময় কেউ হাসি ঠাট্টা, সেলফি ছবি তুলবেন না। ও তো আল্লাহর সন্তুষ্ট জন্য কুরবান হবে। ওর তো আমাদের মত প্রাণের মায়া আছে। হিংস্র ন্যায় ঝাপিয়ে কুরবানি ছুরি চালাবেন না”
“ক্ষমা করিস মৃত্তিকা, আমার মৃত্তিকা”

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *