৯.শ্রীরামকৃষ্ণ
(১৮৩৩-১৮৮৬)
ছেলে বড় হল । পাঁচ বছরে পড়ল গদাধর । কামারপুর গ্রামের লাহাবাবুদের বাড়ির নাটমন্দিরে পাঠশালা । বাবা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় ছেলে গদাধরকে সেই পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দিলেন । কিন্তু পড়াশোনায় খুব বেশি মন নেই গদাধরের । শুধু বাংলাটা পড়তে ভাল লাগে । অংক কষতে গেলেই মাথা গুলিয়ে যায় ।
বামুনের ছেলে । ছোটবেলাতেই মুখে মুখে শিখেছে দেবদেবীর প্রণাম মন্ত্র । সেগুলো কিন্তু বেশ গড়গড়িয়ে বলে যেতে পারে । তার কিছুদিন পরেই রামায়ণ পড়তে পারে সুর করে । বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গলার সুর এবং বলার ভঙ্গি ও তার সুন্দর হয়েছে । তাই মধুযোগীর বাড়িতে তার রামায়ণ পড়া শুনতে ভিড় জমে যায় ।
একদিন বিকেলবেলা সে রামায়ণ পাঠ করছে । বৃদ্ধ বৃদ্ধারাও শুনছে মনোযোগ দিয়ে । কাছেই আমগাছের ওপর বসে ছিল একটা হনুমান । সে লাফ দিয়ে ঠিক গদাধরের কাছে এসে পড়ল । তারপর পা জড়িয়ে ধরল গদাধরের । হইচই করে উঠল সবাই । কেউ বা ভয় পেয়ে উঠে চলে গেল । কিন্তু গদাধর একটুও নড়ল না । সে হনুমানের মাথায় পায়ে হাত বুলিয়ে দিল । বুঝি শ্রীরামচন্দ্রের আর্শীবাদ পেয়েই খুশী হয়ে রামভক্ত হনুমান আবার লাফ দিয়ে গাছে উঠে গেল ।
অদ্ভুত ছেলে গদাধর!সবসময়েই ভাবাবেশে মত্ত হয়ে থাকে । পথে পথে ঘুরে গান করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় । লোকজন ছুটে এসে মাথায় ও মুখে জল ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনে ।
কামারপুর থেকে দু’মাইল দূরে আনুড় গ্রাম । সেখানে বিরাট এক গাছের তলায় আছে বিশালাক্ষীর থান । গাঁয়ের মেয়েরা দল বেঁধে চলেছে সেই বিশালাক্ষী দেবীর পূজা দিতে । হঠাৎ কোথুকে ছুটে এসে গদাধর সেখানে সেই দলে ঢুকে পড়ল । গাঁয়ের মেয়েরা ভাবল, যাক্ ভালই হয়েছে । গদাইয়েরও গান গেয়ে খুব আনন্দ । বাবার কাছ থেকে শেখা দেবতার ভজন কি সুন্দর গায় ।
কিন্তু বিশালাক্ষী থানের কাছাকাছি যেতেই তার গান থেমে গেল। দু’চোখ বেয়ে পড়তে লাগল জলের ধারা । প্রসন্ন বলে মেয়েটি এগিয়ে এসে তাকে ধরতেই তার কোলে অবসন্ন হয়ে ঢলে পড়ল । গদাইয়ের জ্ঞান হতেই সে বলল, ওরে গদাইকে কিছু খেতে দে ।
কিন্তু কি খেতে দেবে গদাইকে ? কারুর সঙ্গে ভোগের সামগ্রী ছাড়া যে আর কিছু নেই । প্রসন্ন বলল,ভোগের জিনিসই আলাদা করে ওকে দে । ওকে খাওয়ালেই তোদের পুণ্যি হবে ।
অনেকে পূজার জন্য আনা নৈবেদ্য থেকে কলা, দুধ ও বাতাসা গদাইয়ের মুখে তুলে দেয় ।
বড় খামখেয়ালী ছেলে গদাধর। পড়াশুনা মোটেই করেছে না । শুধু আড্ডা দিয়ে ঘুরে বেড়ায় । দল বেঁধে ছেলেদের সঙ্গে যাত্রা করে । কখনো সাজে কৃষ্ণ, কখনো শিব । দেখতে দেখতে বড় হতে লাগল গদাধর । দাদা রামকুমার বলেন, গাঁয়ে ওর লেখাপড়া কিছু হবে না । আমি ওকে কলকাতায় নিয়ে যাব । লেখাপড়া শেখাব ।
রামকুমার কলকাতায় ঝামাপুকুরে থাকেন । সেখানে একটা টোল খুলেছেন । সেখানেই ছোটভাইকে নিয়ে যেতে চান । কিন্তু সে গাঁ ছেড়ে যেতে চায় না
১৮৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী এই কামারপুকুর গ্রামে জন্ম হয়েচে গদাধরের । জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছে এখানকার পথ-ঘাট,পুকুর, মা-বাবা ও গাঁয়ের লোক-জনদের । এসব ছেড়ে যেতে কি ভাল লাগে ।
পৈতে হয়েছে । দাই-মা ধনী কামারনীর আদর পেয়েছে । মা চন্দ্রমণির দিকে যেমন টান, ধনী কামারনীর দিকেও টান তার কম নয় । বাবাকেও ভালবাসে খুব । কিন্তু সাত বছর বয়সেই বাবাকে হারাতে হল হঠাৎ । ছিলিমপুরে থাকেন বাবার ভাগনে রামচাঁদ । তার বাড়তে দুর্গাপূজায় পুরোহিত হয়ে পূজা করতে গিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম । সেখানেই ভাসানের দিন রাত্রিবেলায় মারা গেলেন । সেই খবর পেয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদল গদাধর ।
রাসমণির আর কাশী যাওয়া হল না । গঙ্গার তীরে দক্ষিণেশ্বরে মন্দির নির্মাণ করলেন । খরচ হল নয় লাখ টাকা । নবরত্ন বিশিষ্ট কালী মন্দির নির্মাণ করলেন । খরচ হল নয় লাখ টাকা । নবরত্ন বিশিষ্ট কালী মন্দির, উত্তর ভাগে রাধাগোবিন্দ মন্দির,পশ্চিমে গঙ্গার তীর জুড়ে দ্বাদশ শিবের মন্দির । মূর্তিও তৈরী হল । মূর্তি ছিল বাক্সের মধ্যে । দেখা গেল মূর্তি ঘামছে । রাত্রে স্বপ্ন দেখলেন রাণীমা । ভবতারিণী কালী বলছেন, আমাকে আর কতদিন এভাবে কষ্ট দিবি ? এবার আমায় মুক্তি দে ।
১২৬১ সালে বারোই জ্যৈষ্ঠ স্নানযাত্রার দিনে মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্টা হল কিন্তু মায়ের অন্নভোগ দেওয়ার কি হবে ? মার যে অন্নভোগ দেবার অধিকার তোমার নেই কারন তুমি যে জেলের মেয়ে দেবীকে ভোগ দেবো, তাতেও জাতবিচার ? রানীর হৃদয় ব্যাথায় ভরে উঠল রানীর জামাতা মথুরামোহন সব কিছু দেখাশুনা করতেন তিনি নানা দেশের পন্ডিতদের কাছে বিধান নিতে ছুটলেন কিন্তু সব পন্ডিতেরই এক কথা অচ্ছুৎ রামকুমারের কাছে । রামকুমার বিধান দিলেন মন্দিরের যাবতীয় সম্পত্তি যদি রানী কোন ব্রাহ্মণকে দান করেন তবেই অন্নভোগ দেওয়া চলতে পারে । রানী অকূলে যেন কূল পেলেন । তিনি ঠিক করলেন গুরুর নামে মন্দির দান করবেন । কিন্তু গুরুর বংশের কেউ পুরোহিত হয় এ তাঁর কাম্য নয় । কারণ তাঁরা সকলেই অশাস্ত্রজ্ঞ এবং আচারসর্বস্ব । অন্য সৎ ব্রাহ্মণ ও পাওয়া গেল না । অন্য কেউ মন্দিরের পূজা করতে রাজী হলেন না ।
মন্দির প্রতিষ্ঠা-উৎসবের দিন রামকুমার এলেন গদাধরকে সঙ্গে নিয়ে । বিরাট আয়োজন কালীবাড়িতে । যাত্রাগান, কালীকীর্তন,ভাগবত পাঠ । মহা ধুমধাম কান্ড । সকাল থেকে চলছে খাওয়া-দাওয়া আহূত কে অনাহূত, কার কি জাত খোঁজ খবর ও নেয় না কেউ ।
গদাধর কিন্তু কিছু্ই খেলেন না । বাজার থেকে মুড়ি কিনে খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিলেন । রাত্রিবেলা রামকুমার গদাধরকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানকার ভোগের প্রসাদ তুই নিলি না কেন?
গদাধর জবাব দিলেন এমনি নেইনি ।
রামকুমার অবাক হলেন । অথচ এই গদাধরই ছোটবেলায় ধনী কামারনীর কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়েছেন । শিয়র গ্রামের রাখালদের সঙ্গে বসে খেয়েছিল । খেয়েছিল ছুতোর বাড়ির বউয়ের হাতে খিচুড়ি রান্না । চিনিবাস শাঁখারীর হাতে মিষ্টি ।আনুড়ে বিশালাক্ষী মায়ের থানে নানা জাতের মেয়েদের দেওয়া পূজার প্রসাদ খেয়েছিল । তখন তো জাতবিচার করেনি । আশ্চর্য !
কারণ জিজ্ঞেস করলে গদাধর জবাব দিলেন, ওরা দিয়েছিল অতি যত্নের বিদুরের খুদ । কিন্তু এ যে হেলায় ফেলায় দেওয়া দুর্যধনের রাজভোগ ।
জবাব শুনে অবাক হয়ে গেলেন রামকুমার । বাঃ, রামায়ণ মহাভারত পড়ে আর টোলের নানা বই ঘাটাঘাটি করে অনেক কিছু তো এ বয়সে গদাধর শিখে ফেলেছে ।
রামকুমার বললেন, তা হলে কি করতে বলিস আমাকে ? ঝামাপুকুরে ফিরে যাব ? রাণীমা যে আমাকে এখানে পুরোহিত করতে চান । সে কাজ তা হলে নেব না ?
গদাধর বললেন, কথা যখন দিয়েছ তখন ছাড়বে কেন? আর তোমার টোল ও তো প্রায় উঠেই গেছে । তুমি এখানেই থাক ।
মথুরামোহন সেই মূর্তি নিয়ে গেলেন জানবাজারের বাড়িতে । রাসমণিকে দেখিয়ে বললেন, দেখুন মা, পুরুত ঠাকুরের ছোট ভাই গড়েছে ।
রাসমণি বললেন, বাঃ বেশ তো । ওঁকে আমাদের মন্দিরের বিগ্রহের সাজনদার করলে বেশ হয় ।
মথুরামোহন বললেন, আচ্ছা, আমি বলে দেখি পুরুত ঠাকুরকে । পরদিন মথুরামোহন দক্ষিণেশ্বরে এসে রামকুমারকে ব্যাপারটা জানালেন । রামকুমার বললেন, গদাই যা খামখেয়ালী ছেলে । আমার কথা কি শুনবে ? আপনি বললে যদি রাজী হয় ।
মথুরামোহন তখন ডেকে পাঠালেন গদাধরকে । গদাধর ভয়ে ভয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন মথুরাবাবুর সামনে । মথুরাবাবু বললেন, তুমি ঘুরে ঘুরে বেড়াও কেন ? তোমার মনের মতো একটা কাজ দিলে করবে ?
-কি কাজ?
-মা ভবতারিণীকে তুমি নিজের মতো করে সাজাবে ।
ভয়ে কুঁকড়ে উঠলেন গদাধর । বললেন, একা সাহস হয় না সেজবাবু । ঘরে সব দামী দামী জিনিস । সঙ্গে হৃদয় থাকে তো পারি ।
-বেশ তো । সে তোমার সাগরেদ থাকবে । কাজ করবে দু’জনে মিলে ।
মনের মতো কাজ পেয়ে খুশীই হলেন গদাধর ।
জন্মাষ্টমীর পরদিন নন্দোৎসব । রাধা-গোবিন্দের মন্দিরে বিশেষ পূজা ও ভোগ অনুষ্ঠান । সেই বিগ্রহের পূজারী ক্ষেত্রনাথ । দুপুরে পূজোর পর পাশের ঘরে শয়ন দিতে নিয়ে যাচ্ছেন রাধা-গোবিন্দকে । হঠাৎ পা পিছনে ক্ষেত্রনাথ পড়ে গেলেন । হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল গোবিন্দের একটি পা ।
মন্দিরে হইচই পড়ে গেল । হায়, একি অঘটন । রানী রাসমণিকে খবর পাঠানো হল । তিনি মথুরামোহনকে বললেন, পন্ডিতদের কাছ থেকে বিধি নাও, কি ভাবে ঐ বিগ্রহের পূজা করা হবে ? মথুরামোহন অনেক পন্ডিতের সঙ্গেই পরামর্শ করলেন । তাঁরা বললেন, ঐ বিগ্রহের গঙ্গায় বিসর্জন দিতে হবে । তার জায়গায় বসাতে হবে নূতন মূর্তি ।
কিন্তু রাণীর মন তাতে সায় দিল না । সে গোবিন্দকে এতদিন গৃহদেবতা রূপে পূজা করা হয়েছে তাকে বিসর্জন দিতে হবে ?
গদাধরের কানে সে কথা যেতেই তিনি বললেন, সে কি কথা । কোন জামাইয়ের যদি ঠ্যাং ভেঙ্গে যায়, তাতে কি ফেলে দিতে হবে, না চিকিৎসা করাতে হবে । গোবিন্দ গৃহদেবতা, নিতান্ত আপন । সেই আপনজনকে ফেলে দেব কেন? আমিই ঠাকুরের পা জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছি ।
একথা শুনে রাসমণির মনের চিন্তা দূর হয়ে গেল । তিনি বললেন, ছোট ভট্টাচার্য যা বলেছেন তাই ঠিক ।
গদাধর মাটি দিয়ে সুন্দরভাবে জুড়ে দিলেন গোবিন্দের পা । বোঝাই গেল না যে পা ভেঙ্গে গিয়েছিল । সেই মূর্তিই সিংহাসনে বসানো হল ।
ক্ষেত্রনাথ পুরোহিতের কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন । গদাধরকে নিযুক্ত করা হল রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পুরোহিত । গদাধর কোন আপত্তি করলেন না । মতিগতি দিন দিন একটু ভাল হচ্ছে তাঁর । নিজেই একদিন বললেন, আমাকে দীক্ষা দাও ।
কেনারাম ভট্টাচার্য নামে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণকে এনে গদাধরকে দীক্ষা দেওয়া হল । তারপর থেকে পূজার দিকে খুব মন দিলেন গদাধর । রামকুমার ভাবলেন, গদাইয়ের হাতে ভবতারিণীর পূজোর ভার দিয়ে কিছুদিনের জন্য দেশ থেকে ঘুরে আসি । তাই গদাধরকে শক্তি পূজার পদ্ধতি শেখাতে লাগলেন ।
গদাধর এখন আগের চাইতে অনেক সংযত ও ধীরস্থির । কিছুদিন পর ভবতারিণীর পূজার ভার গদাইয়ের আর রাধাগোবিন্দের পূজার ভার হৃদয়ের হাতে দিয়ে রামকুমার দেশের দিকে রওনা হয়ে গেলেন । কিন্তু বিধির কি আশ্চর্য লীলা ! রামকুমার বাড়িতে গিয়ে পৌছাতে পারলেন না । পথেই অসুস্থ হয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন । সেখানেই মারা গেলেন ।
সে খবর শুনে কি কান্নাই না কেঁদেছিলেন গদাধর ।
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে ।
দেশ থেকে ঘুরে এসে ভবতারিনীর পূজায় মন দিয়েছেন গদাধর । কিন্তু পূজার ধরন-ধারণ যেন পালটে গেছে অনেক । হৃদয় অবাক হয়ে গেল তার ছোটমামার হাবভাব দেখে । একদিন দেখল গদাধর মায়ের মূর্তির হাত টিপে দেখলেন তারপর ছুটে চলে গেলেন বাইরে । ভূত প্রেত সাপ নেউলের ভয় নেই । পঞ্চবটী বনের মধ্যে ঢুকে পড়লেন । পরনের কাপড় খুলে গেল, গলার পৈতে লুটোপুটি খেতে লাগল মাটিতে ।
আর একদিন দেখল হৃদয়, গদাধর মা কালীর মূর্তির সামনে বসে কাঁদছেন । বলছেন, মা গো রামপ্রসাদকে তুই দেখা দিয়েছিস, আমাকে দেখা দিবি না কেন?
হৃদয় একদিন জিজ্ঞেস করল, মামা এসব ঢং করো কেন ? গদাধর জবাব দিলেন ওসব ঢং নয় রে । মাকে পেতে হলে শাপমুক্ত হতে হবে । অষ্ট পাশ । ক্ষুধা, লজ্জা, কুল, শীল, ভয়, মান, জাত, দম্ভ এসব ছাড়তে হয় ।
পঞ্চবটীতে সারারাত পঞ্চমুন্ডিত আসনে বসে ধ্যান করেন গদাধর । রাত্রি শেষে বেরিয়ে আসেন । পা টলছে মাতালের মত । মন্দির খুলতে না খুলতেই ঢুকে পড়লেন ভেতরে । বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, দেখা দিবি না ? বেশ, চাই না দেখতে । রাক্ষসী তুই তাই তো রক্ত মেখে মুন্ডুমালা গলায় রাখিস । আরো খাবি রক্ত ?
মন্দিরের দেওয়ালে ঝুলছে বলির খাঁড়া । সেই খাঁড়াটি নিয়ে নিজের গলা কাটবার জন্য তুলে ধরলেন । মন্দিরের আঙিনায় তখন ভিড় জমে গেছে । কিন্তু হঠাৎ প্রতিমার পায়ের কাছে মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন গদাধর । ধরাধরি করে অচেতন গদাধরকে নিয়ে যাওয়া হল তাঁর ঘরে । পরের দিনও নয় । সময় সময় একটু জ্ঞান হয় আর কি যেন বিড় বিড় করে বলেন । আবার জ্ঞান হারিয়ে যায় ।
সিয়রে হৃদয়ের বাড়িতে গেলেন গদাধর । সেদিন সেখানে গানের আসর বসেছিল । একটি স্ত্রীলোকের কোলে ছিল একটি ফুটফুটে মেয়ে । টুল টুল করে তাকিয়ে চারদিক দেখীছল । স্ত্রীলোকটি রহস্য করে জিজ্ঞেস করল মেয়েটিকে, বিয়ে করবি ? মেয়েটি ঘাড় নাড়ল ? কাকে বিয়ে করবি এত লোকের মধ্যে ?মেয়েটি গদাধরকে দেখিয়ে বলল, ঐ যে !
মেয়েটি জয়রামবাটির রামচন্দ্র মুখুজ্যের মেয়ে সারদামণি । একদিন শুভলগ্নে গদাধরের সঙ্গে ওরই বিয়ে হয়ে গেল । প্রায় দু’বছর কামারপুকুরে থাকার পর দক্ষিণেশ্বরে ফিরলেন । মা কালীর পূজোর ভার আবার তাঁরই ওপর পড়ল ।
রানী রাসমণির অসুখ । হঠাৎ একদিন পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যাথা পেলেন । শয্যাশায়ী হলেন একেবারে ।
মনে শান্তি নেই রাসমণির । আঠারোশো একষট্টি সালের আঠারোই ফেব্রুয়ারি সেই সম্পত্তির দানপত্র রেজিষ্ট্রি হয়ে গেল । পরের দিন রাসমণি বললেন, আমাকে কালীঘাটে নিয়ে চল । সেখানেই মায়ের কাছে শেষ নিঃশ্বাস ফেলব ।
বিছানা সাজিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী রাণীর দেহ আনা হল আদিগঙ্গার তীরে । আমাবস্যার অন্ধকার রাতে রানীর পুণ্যাত্মা দেহ ছেড়ে চলে গেল । দক্ষিণেশ্বরে ঘরের বারান্দায় অস্থির ভাবে পায়চারি করেছিলেন গদাধর । হঠাৎ বলে উঠলেন, চলে গেল রে, চলে গেল রাসমণি । মায়ের অষ্টনায়িকার এক নায়িকা ।
একদিন সকালবেলা বাগানে ফুল তুলছেন গদাধর । এমন সময় বকুলতলার ঘাটে একটি নৌকা এসে ভিড়ল । এক সুন্দরী স্ত্রীলোক নামলেন নৌকা থেকে । পরনে গেরুয়া শাড়ি, হাতে ত্রিশূল । বয়স হয়েছে ভৈরবীর । কিন্তু কী রূপের ছটা । গদাধরকে বললেন, এই যে বাবা, তুমি এখানে । জানি তুমি গঙ্গাতীরে আছ । তাই তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি ।
শুনে গদাধর অবাক । তুমি আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছ মা?
মা মহামায়াই পাঠিয়ে দিলেন ।
পঞ্চবটীতে ভৈরবীর থাকবার ব্যবস্থা হল । তিনি সেখানে থাকেন । তাঁর ঝোলায় আছে তন্ত্রশাস্ত্র, গীতা,ভগবত্ । গদাধরকে পড়ে শোনান । নানা বিষয়ে আলোচনা হয় । শাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান ভৈরবীর । কিন্তু নানা লোকের মনে নানা রকম সন্দেহ । সুন্দরীর ভৈরবঅ কি রম্ভা মেনকার মত গদাধরের মনের পরিবর্তন ঘটাতে এসেছেন ? কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখা গেল, ভৈরবী এসেছেন গদাধরের প্রকৃত রূপ উদঘাটনের জন্য । তিনি বললেন, গদাধর মানব দেহধারী শ্রীরামচন্দ্র । তান্ত্রিক মতে শক্তি-দীক্ষা তিনি দিলেন গদাধরকে ।
একদিন মড়ার মাথার খুলিতে মাছ বেঁধে ভোগ সাজালেন কালীকে নিবেদন করে গদাধরকে বললেন, প্রসাদ নাও গদাধর নির্বিবাদে প্রসাদ গ্রহণ করলেন
ভৈরবী বললেন, এবার বৈষ্ণবমতে সাধনা কর বাবা চারটি বেদ, আঠারোটি পুরাণ, চৌষট্টি তন্ত্রে যে রাস মেলে না, তাই মেলেনা, তাই মেলে বৈষ্ণব মতে সাধনায়
গদাধর রাজী হলেন কী অপূর্ব যোগাযোগ ! সেই সময়ে এলেন বেদান্তপন্থী অদ্বৈতবাদী সন্ন্যাসী পরমহংসদেবের দল তাঁদের সঙ্গে করেন শাস্ত্র আলোচনা অতি সহজভাবে গভীর তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করলেন সাধুরা খুশী হলে আশীর্বাদ করে গদাধরকে বললেন, তুমি ধর্মের সারমর্ম বুঝেছ তুমি পরমহংস
কিছুদিন পর এলেন সন্ন্যাসী তোতাপুরী পাণ্জাবের লুধিয়ানায় তাঁর মঠ চল্লিশ বছর সাধনা করেছেন বেরিয়েছেন তীর্থ দর্শনে তাঁকে দেখে গদাধর ভক্তিভরে প্রণাম করলেন যেন কতকালের পরিচিত গদাধর বললেন, আমাকে দীক্ষা দিন ।
তোতাপুরী বললেন, দিতে রাজী আছি , কিন্তু তোমাকে গৈরিক বস্ত্র পরতে হবে । গদাধর বললেন, গৈরিক পরতে পারব না । ছোটবেলাতেই মায়ের কাছে কথা দিয়েছি । সন্ন্যাসী না সেজেও আমি সন্ন্যাস নেব ;
তোতাপুরী ভাবলেন, মনে যার রং ধরেছে, তার দেবহারণের রং বিচার করে লাভ নেই । তাই তিনি গদাধরকে দীক্ষা দিলেন । বললেন, আজ তোমার নতুন জন্মলাভ হল । তোমার নাম এখন হবে রামকৃষ্ণ আর পদবী হবে পরমহংস । পরমহংস কাকে বলে জান তো ? দুধে জলে এক সঙ্গে থাকলেও যিনি হাসের মত জলটি ছেড়ে দুধটি নিতে পারেন, তিনিই পরমহংস ।
তোতাপুরী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন । ক’দিন পরেই এলেন গোবিন্দ রায় । জাতে ক্ষত্রিয় । কিন্তু মুসলমান হয়েছেন । আরবী ফারসীতে পন্ডিত । রামকৃষ্ণ তাকে বললেন, আমি মুসলমান ধর্মমতে সাধন ভজন করব । কত মানুষ কত পথে সাধনা করে বাঞ্চিত ধামে গিয়ে পৌঁছায় । আমি এই পথটাকে বাদ দেব কেন ?
গোবিন্দ রায় দীক্ষা দিলেন রামকৃষ্ণকে । কাছা খুলে ফেললেন । কাপড় পরলেন লুঙ্গির মত করে । পাঁচ বেলা নামাজ পড়তে লাগলেন । একদিন মুসলমানদের রান্নার মত রান্না করিয়ে খেলেন ।
একদিন ভাবাবিষ্ট অবস্থায় রামকৃষ্ণ দেখলেন গৌরবর্ণ সুপুরুষ যীশিুখ্রীস্ট এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়েছেন । যীশুর ভজনা করতে করতে তিনি সমাধিস্থ হয়ে গেলেন ।
মা চন্দ্রমনিও ছেলে গদাধরকে দেখবার জন্য দক্ষিণেশ্বরে এলেন । তিনি নহবতের ঘরে থাকেন । ছেলের সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয় । কিছুদিনের পর স্ত্রী সারদামণিরও এসে হাজির হলেন । রামকৃষ্ণ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কি গো, তুমি কি আমাকে সংসার পথে টেনে নিতে এসেছ ?
সারদা জবাব দিলেন, না । তোমার ইষ্টপথে সাহায্য করার জন্যই আমি এসেছি ।
ঠাকুর রামকৃষ্ণের শিক্ষায় শ্রীমতি সারদা সুনিপুণা হতে লাগলেন । প্রকাশ পেতে লাগলেন জগতের মঙ্গলসাধিকা শক্তিরূপে ।
চন্দ্রমণির বয়স অনেক হয়েছিল শেষ বেয়সে ছেলেকে দেখবার আকাঙ্খা হয়েছিল ভিষণ । সে আশা তাঁর পুরণ হল । একদিন দক্ষিণেশ্বরেই রোগশয্যায় পুত্রকে শিয়রে রেখে মা চোখ বুজলেন ।
রামকৃষ্ণ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন । দক্ষিণেশ্বরে ও হয়ে উঠেছে তীর্থভূমি । সেখানে মাঝে মাঝেই এসে উপস্থিত হন কত সাধুপুরুষ, কত গুণী জ্ঞানী । বিখ্যাত মানুষ । তিনিও মাঝে মাঝে বিখ্যাত মানুষদের বাড়ি যান । একদিন গেলেন মহষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি । খ্রীস্টধর্মের বন্যায় যখন দেশটা ডুবে যাবার উপক্রম হয়েছিল তখন ব্রাহ্মণধর্মের জীবন তরণী ভাসিয়ে বহু মানুষকে উদ্ধার করেছেন । দেবেন্দ্রনাথকে রামকৃষ্ণ বললেন, তুমি তো পাকা খেলোয়াড় হে । একসঙ্গে দু’খানা তলোয়ার ঘোরাও, একটি কর্মের আর একটি জ্ঞানের ।
ব্রাহ্মণধর্মের অন্যতম প্রবর্তক কেশবচন্দ্র সেনের বাড়িও গেলেন একদিন । সেখানে গিয়ে গান করতে করতে রামকৃষ্ণ সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন । আর একদিন গেলেন বিদ্যাসাগরের বাড়িতে । বললেন, এতদিন খাল বিল দেখেছি, এবার সাগর দেখলুম । বিদ্যাসাগর হেসে বললেন, তবে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান । রামকৃষ্ণ বললেন, না গো! নোনা জল কেন? তুমি যে বিদ্যার সাগর, ক্ষীরসমুদ্র । নরেন্দ্রনাথ নিজেই এসেছিলেন রামকৃষ্ণের কাছে । বিখ্যাত দত্ত বাড়ির ছেলে, শিক্ষিত তরূণ । রামকৃষ্ণের প্রভাবে তিনি হয়ে গেলেন স্বামী বিবেকানন্দ ।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ শুধু সাধকই নন , তিনি যে প্রেমাবতার । প্রেম বিলাতে বিলাতে তিনি মানুষের মনের কলুষ কে দূর করতে লাগলেন, মানুষের মনের পাপ হরণ করতে গিয়ে নিজেই হলেন নীলকণ্ঠ ।
গলায় তাঁর ক্ষতরোগ হল । ক্যান্সার । চিকিৎসার জন্য তাঁকে চিকিৎসকের নির্দেশে শিষ্যদের এবং সাধারণ মানুষের তাঁর কাছে যেতে মানা । কিন্তু প্রেমের ঠাকুর রামকৃষ্ণ সেই নিষেধ উপেক্ষা করে কল্পতরু উৎসবের অনুষ্ঠান করলেন । সর্বধর্মের সকল শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে হৃদয়ের প্রেম নিঃশেষ বিতরন করতে লাগলেন ।
ইংরেজি ১৮৮৬ সাল, বাংলা ১২৯৩ সালের ১ লা ভাদ্র মহাসমাধিতে নিমগ্ন হলেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ ।