১০. শ্রীচৈতন্য
(১৪৮৬-১৫৩৩)
মধ্যযুগে মুসলমানেরাই ছিলেন এ দেশের শাসক । ইসলাম ছিল রাজধর্ম । ইসলাম ধর্ম ছিল উন্মুক্ত। ধর্মের মধ্যে উচু-নিচু ভেদাভেদ, জাতিভেদ ছিল না । মসজিদে ছিল সকলের প্রবেশাধিকার । মক্তব-মাদ্রাসায় যে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত ।
অপরদিকে হিন্দুসমাজ ছিল একেবারে বিপরীত । ধর্মের এক অচলায়তন । জাতিভেদ আর সংকীর্ণ গোঁড়ামিতে সমস্ত সমাজ শতবিভক্ত । শাক্ত, বৈষ্ঞব, শৈব,সৌর, ব্রাহ্মণ সকলেই অন্যের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত । পরস্পরের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ আর ঘৃণা । মন্দির, পূজামন্ডপের দ্বার শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের মানুষদের জন্যই উন্মুক্ত । সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষের কোন স্থান নেই সেখানে ।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনে কোন সুখ ছিল না, শান্তি ছিল না । হিন্দুদের উপর চলত সুলতানী সৈন্যদের অত্যাচার । লুঠতরাজ ছিল সাধারণ ঘটনা । সুন্দরী মেয়েদের উপর ছিল না তার । সমাজ তাকে রক্ষা করত না শাস্তি দিতে দ্বিধা করত না ।
জীবনের সর্বস্তরে ছিল হাজার ছুৎমার্গের বেড়াজাল । ব্রাহ্মণদের জন্যই শুধু ছিল শিখার সুযোগ । তাদের প্রবল প্রতাপে অতিষ্ঠ হয়ে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষ দলে দলে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে । হিন্দু সমাজের এই সর্বনাশা অবক্ষয়ের যুগে শ্রীচৈতন্যর আবির্ভাব ।
১৪৮৬ খৃস্টাব্দের ১৯ শে ফেব্রুয়ারি । বাংলা ফাল্গুন মাসের দোলপূর্ণিমা । সেদিন ছিল চন্দ্রগ্রহণ । নবদ্বীপের মায়াপুর পল্লীতে নিমাইয়ের জন্ম হল । পিতা জগন্নাথ মিশ্র, মাতা শচীনদেবী । সেই সময় দাদা বিশ্বরূপের বয়স ছিল দশ । ছেলেবেলা থেকেই বিশ্বরূপ ছিলেন শান্ত, সংসারের প্রতি উদাসীন । মাত্র ষোল বছর বয়েসে সংসারের সব বন্ধন ছিন্ন করে সন্ন্যাস নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন । আর তাঁর কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি ।
জ্যেষ্ঠপুত্রের এই বিচ্ছেদ ব্যাথা কিছুতেই ভুলতে পারেন না জগন্নাথ মিশ্র । কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন । বালক পুত্রকে নিয়ে সংসারের সব ভার নিজের কাধে তুলে নিলেন শচীনদেবী ।
বালক নিমাই ভর্তি হলেন গঙ্গাদাস পন্ডিতের চতুষ্পাঠীতে । যেমন মেধাবী তেমনি চঞ্চল। কৈশোর উত্তীর্ণ হতেই হয়ে উঠলেন । নানা শাস্ত্রে সুপন্ডিত । কিন্তু যেমন তার্কিক তেমনি অহংকারী । কূট প্রম্ন তুলে মানুষকে বিব্রত করতে আনন্দ পেতেন ।
সংসারে অভাব অনটন, তাই নিজেই টোল স্থাপন করলেন নিমাই পন্ডিত । তাঁর খ্যাতি আর পান্ডিত্যের আকর্ষণে অল্প দিনেই টোল ভরে উঠল । পুত্রকে উপার্জনক্ষম দেখে শচীমাতা লহ্মী নামে সুলহ্মণা এক কন্যার সাথে তার বিবাহ দিলেন ।
এই সময় কেশব নামে কাশ্মীরের এক পন্ডিত বিভিন্ন স্থানের পন্ডিতদের তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে নবদ্বীপে এলেন । তার পান্ডিত্যের কথা শুনে স্থানীয় কোন পন্ডিতই তার সাথে বিচারে অবতীর্ণ হতে সাহসী হলেন না । অবশেষে কেশব নিমাই পন্ডিতের দর্শন পেয়ে তাঁকেই বিচারে আহ্বান করলেন । কেশব মুখে মুখে গঙ্গার স্তব রচনা করলেন । সকলে মুগ্ধ । কিন্তু নিমাই প্রতিটি শ্লেকের অশুদ্ধি আর অপপ্রয়োগ নির্ণয় করে কেশবকে পরাজিত করলেন । নিমাইয়ের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ।
কিছুদিনের জন্য পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে গেলেন নিমাই । সেখানে যথেষ্ঠ খ্যাতি সম্মান অর্থ পেলেন । নবদ্বীপে ফিরে এসে এক বেদনাদায়ক সংবাদ পেলেন । স্ত্রী লক্ষ্মী সাপের কামড়ে মারা গিয়েছে । শোকের আবেগটা স্তিমিত হয়ে আসতেই শচীদেবী পুনরায় নিমাইয়ের বিবাহের ব্যবস্থা করলেন । কন্যার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া । সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে ।
পিতা জগন্নাথ মিশ্র বহুদিন মারা গিয়েছেন । তাঁর পিন্ডদান করতে গয়ায় গেলেন নিমাই । সেখানে বিষ্ণুপাদপদ্ম দেখে তার মধ্যে জেগে উঠল এক পরিবর্তন । চঞ্চল উদ্ধত অহংকারী নিমাই চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন । তার মধ্যে জন্ম নিল কৃষ্ণ অনুরাগী এক প্রেমিক সাধক । দিন রাত শুধু কৃষ্ণের বিরহে ব্যাকুল । যা কিছু দেখেন তাকেই কৃষ্ণ বলে আলিঙ্গন করেন । তার এই আকুলতা দেখে সকলে বিস্মিত । এতো পরম সাধকের লক্ষণ ।
টোলে অধ্যাপনায় আর কোন আগ্রহ নেই । সামনে খোলা পুঁথি পড়ে থাকে । ছাত্ররা কলরব করতে থাকে । নিমাই তাদের নিয়ে নামকীর্তন আরম্ভ করেন । এক এক সময় ভাবে বিভোর হয়ে যান । বাহ্য জ্ঞান থাকে না । তার এই অপ্রকুতিস্থ ভাব দেখে শচীদেবী, বিষ্ণুপ্রিয়া ব্যাকুল হয়ে ওঠেন ।
সেই সময় বৈষ্ণবদের সমাজে তেমন কোন প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল না । সংখ্যাতে ও তারা ছিল নগণ্য । নিমাইকে পেয়ে বৈষ্ণব সমাজের বুকে যেন প্রাণের জোয়ার বয়ে যায় ।
অদ্বৈত আচার্য ছিলেন বৈষ্ণব সমাজের প্রধান । জ্ঞান ভক্তিতে তাঁর কোন তুলনা ছিল না । নিমাইকে দেখা মাত্রই তাঁর মনে হল মানব যেন তার আরাধ্য দেবতার আবির্ভাব ঘটেছে । এতদিন তিনি যেন এই মানুষটিরই প্রতীক্ষা করছিলেন । বৃদ্ধ দ্বৈত পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে নিমাইকে বরণ করে নিলেন । সমস্ত বৈষ্ণব সমাজ তাকে নেতা হিসেবে স্বীকার করে নিল ।
একদিন নগর কীর্তন করতে করতে নিমাই এসে পড়লেন নন্দন আচার্যের গৃহে । সেখানে ছিলেন সুদর্শন এক অবধূত । বয়সে তরূণ, মুখে স্নিগ্ধ ভাব, নাম নিত্যানন্দ । নিত্যানন্দের জন্ম রাঢ় অঞ্চলের একচাকা গ্রামে । বাবার নাম হাড়াই ওঝা । মায়ের নাম পদ্মাবতী । এঁরা ছিলেন রাঢ়ীয় শ্রেণীর ব্রাহ্মণনি বৃন্দাবন থেকে বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করতে করতে এলেন নবদ্বীপে । নিমাইয়ের দর্শন পেতেই আকৃষ্ট হলেন তাঁর প্রতি । তিনি হয়ে উঠলেন নিমাইয়ের প্রধাণ পার্ষদ ।
শ্রীবাসের গৃহপ্রাঙ্গণে চলে নিত্যদিন নামগান আর কীর্তন করতেন । সেখানেই শুধুমাত্র গৃহপ্রাঙ্গনে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সর্ব মানুষের দ্বারে দ্বারে । তিনি নামগান করার ভার দিলেন তার গুই প্রধাণ ভক্ত নিত্যানন্দ আর যবন হরিদাসকে । একজন হিন্দু অন্যজন মুসলমান । সেই যুগে এ এক দুঃসাহসিক কাজ । সমস্ত ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্দ্ধে উঠে একজন মুসলমানকে দিয়ে বৈষ্ণবধর্মের প্রচার-মধ্যযুগে এ ছিল কল্পনীয় ।
নগরের পথে পথে ঘুরে ঘুরে তারা কীর্তন করতেন । অনেকে ভাবরসে আপ্লুত হয়ে তাদের সঙ্গী হত । অনেকে বিদ্রুপ করত, উপহাস করত । বিশেষত ব্রাহ্মণ সমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকে । নীচ ধর্মের মানুষেরা যদি এভাবে অপর সকলের সাথে সমমর্যাদা পায় তবে যে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি রসাতলে যাবে । জগাই আর মধ্যেই নামে দুই পাপাচারী ব্রাহ্মণ, যারা সকল পাপকর্মে সিদ্ধ তাদের প্ররোচিত করে । একদিন নগরের পথে নামগান করছেন নিমাই আর নিত্যানন্দ । মদ্যপ অবস্থায় দুই ভাই নামকীর্তন বন্ধ করার জন্য চিৎকার করে ওঠে । আত্মহারা নিমাইয়ের কোন কথাই কানে যায় না । রাগেতে মাধাই কলসীর ভাঙা টুকরো তুলে নিয়ে ছুড়ে মারে । নিত্যানন্দের মাথায় এসে আঘাত লাগে । অঝোরে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ে । সেই দৃশ্য দেখে ক্রুদ্ধহয়ে ওঠেন নিমাই । তার সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে বহু কষ্টে শান্ত করান নিত্যানন্দ । দুই ভাই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অনুতাপে লজ্জায় শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন নিমাইয়ের । জয় হয় প্রেমধর্মের ।
এই ঘটনা নবদ্বীপের মানুষের মনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে । চারদিকে বেড়ে চলে সমবেত কীর্তন আর নামগান । তখন বাংলার সুলতান ছিলেন হোসেন শাহ । বৈষ্ণবদের এই ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ভাল চোখে দেখলেন না । তাছাড়া কিছু গোড়া মুসলমানও এর বিরুদ্ধে নালিশ জানাল । চাঁদ কাজী প্রকাশ্য পথে সমবেত কীর্তন বন্ধ করার হুকুম দিলেন ।
ভক্তমন্ডলী ভীত হয়ে পড়ল । কিন্তু শ্রীগৌরাঙ্গ আদেশ দিলেন সন্ধ্যাবেলায় নগরের পথে কীর্তন হবে । শুধু বৈষ্ণবরা নয়, সাধারণ মানুষও দলে দলে যোগ দিল সেইনগর কীর্তনে । প্রকৃত পক্ষে সেদিন নিমাই যে জনজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন,ইতিহাসে তা বিরল । তাঁর এই শক্তির উৎস ছিল জনগণের সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ । তিনি ধর্ম বর্ণ বৈষম্য মুছে ফেলে সকল মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে উঠছিলেন । তাই মানুষ তার ডাকে অমন করে সাড়া দিয়েছিল।
নিমাইয়ের ডাকে বার হতেই সস্নেহে নিমাই তার সাথে কথা বললেন । নিমাইয়ের মধুর সম্বোধন, তার আন্তরিকতা, অকৃত্রিম ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন কাজী । হরিনাম সংকীর্তনের উপর থেকে সব বিধিনিষেধ তুলে নিলেন । প্রকৃতপক্ষে নিমাই তার প্রেমের শক্তিতে মুসলমান শাসকের কাছ থেকে অবাধ ধর্মাচরণের স্বাধীনতা অর্জন করেছিলেন ।
গয়াধাম থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নিমাইয়ের জনপ্রিয়তা শুধু বৃদ্ধি পায়নি, তার অনুগামী বৈষ্ণবদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায় । কিন্তু তিনি উপলব্ধি করতে পারছিলেন শুধু নবদ্বীপ নয়, তাঁর কর্মক্ষেত্রকে ছড়িয়ে দিতে হবে আরো বৃহৎ জগতের মাঝখানে । তাঁর এই ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলেন নিত্যানন্দ ও আরো কয়েকজন অন্তরঙ্গ পার্ষদের কাছে । জননী শচীদেবীর কাছেও প্রকাশ করলেন নিজের মনের ইচ্ছা । কিন্তু কোন মা তাঁর পুত্রকে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দেয়?
১৫১০ খ্রীস্টাব্দে ২৬ শে মাঘ গভীর রা্ত্রে গৃহত্যাগ করলেন নিমাই । সকলে গভীর ঘুমে অচেতন । নিমাই গঙ্গা পার হয়ে অপর পারে কাটোয়ায় গেলেন । সেখানে ছিলেন কেশব ভারতী । তার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে সন্ন্যাস নিলেন । তার নতুন নাম হল শ্রীচৈতন্য ।
শ্রীচৈতন্যের লক্ষ্য নীলাচল । তার অনুগামী ভক্তরা দলে দলে এসে হাজির হয় কাটোয়ায় । প্রভুর বিরহ তারা কেমন করে সহ্য করবে ! সকলের অনুরোধে শান্তিপুরে শ্রীঅদ্বৈতের গৃহে কয়েকদিনের জন্য রয়ে গেলেন । শচীদেবী এসে পুত্রের সাথে দেখা করলেন । সকলের কাছে বিদায় নিয়ে শ্রীচৈতন্য এবার যাত্রা করলেন উড়িষ্যায় পথে । নীলাচলে প্রভু জগন্নাথের দর্শন পাবার জন্যে তার সমস্ত মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল ।
উড়িষ্যা যাত্রা পথে তার সঙ্গী অল্প কয়েকজন ভক্তশিষ্য আর অনুগামী । জগন্নাথের মন্দিরে প্রবেশ করতেই ভাবে বিহল চৈতন্যদেব জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন; প্রহরীরা বাধা দিতে ছুটে এল । সেই সময়ে সেখানে এসেছিলেন উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্রের গুরু মহাপন্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম । তিনি শ্রীচৈতন্যের অপরূপ দেহলাবণ্য প্রেমবিহ্বল ভাব দেখে তাকে নিজের গৃহে নিয়ে গেলেন ।
বাসুদেব সার্বভৌম শুধু যে উৎকলের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈদান্তিক । তার এই আত্মসমর্পণ শুধু যে উড়িষ্যায় আলোড়ন তুলল তাই নয়, সমস্ত দেশের পন্ডিতরা বিস্মিত হল । মাত্র ২৪ বছরের এক তরুণ কোথা থেকে পেল এমন ঐশীশক্তি যার বলে বাসুদেব সার্বভৌমের মত মানুষ নিজের সব সত্তা বির্সজন দিয়ে শ্রীচৈতন্যের পাদপদ্মে নিজেকে সমর্পণ করেছেন । অল্প দিনের মধ্যেই নীলঅচলের মানুষ প্রভুর প্রেমের জোয়ারে ভেসে গেল ।
কিছুদিন পর শ্রীচৈতন্য স্থির করলেন দক্ষিণ ভারতে যাবেন । সেখানকার সব তীর্থ দর্শন করবেন । কোন সঙ্গী নেই সাথী নেই, একাই রওনা হলেন ।
বিদ্যানগরের শাসক ছিলেন রামানন্দ রায় । উৎকল রাজ্যের প্রতিনিধি পরম ধার্মিক বৈষ্ণব । শ্রীচৈতন্যকে দেখামাত্রই ভাবে আবিষ্ট হয়ে গেলেন রামান্দ রায় । মনে হল শ্রীচৈতন্যই তার ধ্যানের দেবতা । রামানন্দ রায়ের অনুরোধে সেখানে কয়েক দিনের জন্য রয়ে গেলেন শ্রীচৈতন্য ।
দশ দিন পর আবার শ্রীচৈতন্য যাত্রা করলেন দক্ষিণের পথে । একের পর এক তীর্থ দর্শন করতে থাকেন । গেলেন শ্রীরঙ্গক্ষেত্রে, রামেশ্বর, ত্রিবাঙ্কর, আরো বহু স্থান । যেখানেই যান সেখানেই কৃষ্ণনামের জোয়ার বয়ে যায় । শ্রীচৈতন্যের এই দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ ঐতিহাসিক দিক থেকেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ । তিনি যে প্রেমধর্মের প্রচার করেছিলেন তা দীর্ঘদিন স্থায়ী ছিল ।
প্রায় দু বছর দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ করে আবার নীলাচলে ফিরে এলেন শ্রীচৈতন্য । তার বিরহে ভক্ত শিষ্যরা সকলেই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল । শ্রীচৈতন্যকে ফিরে পেয়ে সমস্ত নীলাচল যেন উৎসব নগরী হয়ে উঠে ।
যে সব ভক্ত শিষ্যরা যারা নবদ্বীপ ছেড়ে প্রভুর সাথে নীলাচলে এসেছিল, দীর্ঘদিন পরবাসে থেকে সকলেরই মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল । শ্রীচৈতন্য ও উপলব্ধি করেছিলেন । তাছাড়া তার অবর্তমানে বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারের জন্য উপযুক্ত মানুষের প্রয়োজন । সে কাজের ভার তুলে দিলেন নিত্যানন্দের উপর । শুধু তাই নয়, তিনি বললেন সংসারী হয়ে তুমি গৃহী মানুষের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার কর ।
১৫১৪ সালে বিজয়া দশমীর দিন নীলাচল ত্যাগ করে যাত্রা করলেন নবদ্বীপের পথে । প্রথমে এলেন কটকে । স্থানীয় মুসলমান শাসকরাও তার প্রেমগানে এতখানি মুগ্ধ হয়েছিলেন যে নদী পার করে গৌড়ে পৌছবার সকল ব্যবস্থা করে দিলেন ।
শ্রীচৈতন্য এলেন কুমারহট্ট গ্রামে শ্রীবাসের গৃহে । তারপর শান্তিপুর হয়ে এলেন নবদ্বীপে । তার শৈশব কৈশোর যৌবনের কিছু অংশের লীলাভূমি এই নবদ্বীপে । নবদ্বীপবাসীরাও শ্রীচৈতন্যের নামগানে বিভোর ।
শচীমাতা এলেন পুত্র দর্শনে । কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া কূলবধূ, তাছাড়া সন্ন্যাস গ্রহণের পর তো সন্ন্যাসীর স্ত্রীমুখ দর্শন নিষিদ্ধ । তবুও তার সমস্ত অন্তর স্বামী দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে । সব দ্বিধা-সংকোট দূর করে বিষ্ণুপ্রিয়া এলেন । শ্রীচৈতন্যের কাছে এসে প্রণাম করতেই প্রভু বললেন,তুমি কৃষ্ণপ্রিয়া হও ।
শ্রীচৈতন্য নিজে কোন ধর্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেননি । নিজে কোন ধর্মগ্রন্থও রচনা করেননি ।
সচরাসচর উপদেশও দিতেন না তবুও হাজার হাজার মানুষ এক অদৃশ্য আকর্ষণে বার বার তাঁর কাছে ছুটে এসেছে । কারণ তার মত এমন করে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে কেউ প্রেমের মন্ত্র প্রচার করেনি । তিনি সে যুগের অধিকাংশ সাধু-সন্তের মত মানবতা-বিমুখী সন্ন্যাসী ছিলেন না । তাঁর মধ্যে ছিল মানবীয় চেতনা, তাই তিনিই প্রথম দক্ষিণ ভারতের ঘৃণা দেবদাসী প্রথা বিলোপ করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন । নারীদের প্রতি তার ছিল অপরিমেয় শ্রদ্ধা । তিনি পারস্পরিক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ক্ষত-বিক্ষত ভারতবর্ষের বুকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন শান্তি আর ঐক্য । প্রধাণত তাঁরই চেষ্টায় হোসেন শাহ ও রাজা প্রত্যপরুদ্র পারস্পরিক যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হয়েছিলেন ।
তিনি মানুষকে মর্যাদা দিয়েছেন মানুষ হিসেবে । তাঁর মধ্যেই বাংলার মানুষ খুঁজে পেয়েছিল একসাহসী ব্যক্তিত্বপূর্ণ পুরুষকে যিনি অত্যাচারী শক্তির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, সৃষ্টি করেছিলেন গণ প্রতিরোধ । কিন্তু তিনি যে ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের সূচনা করেছিলেন, যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে সেই মহৎ সম্ভাবনা পূর্ণ হয়নি ।
১৫২২ খৃস্টাব্দে, শ্রীচৈত্যন্যের তখন ৩৬ বছর বয়স প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকেই তার মধ্যে শুরু হয় দিব্যোন্মাদ অবস্থা । বাহ্য জগতের সাথে সম্পর্ক ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসে । অধিকাংশ সময়ই কৃষ্ণনামে বিভোর হয়ে থাকতেন ।
১৫৩৩ খৃস্টাব্দের ২৯ শে জুন, আষাঢ় মাস । শ্রীচৈতন্য তখন অধিকাংশ সময়ই ভাবে বিহ্বল হয়ে থাকতেন । এক এক সময় বাহ্য জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত পথে বার হয়ে পড়তেন । শিষ্যরা প্রতিনিয়ত তাকে পাহারা দিত ।
প্রতিদিন প্রভু একবার করে জগন্নাথের মন্দিরে যেতেন । সেদিনও মন্দিরে গিয়েছেন । তিনি সাধারণত নাটমন্দিরের গরুর স্তম্ভের নীচে গিয়ে দাড়াতেন, সেখান থেকে দর্শন করতেন প্রভু জগন্নাথকে । কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে প্রবেশ করলেন ।সাথে সাথে মন্দিরের দরজা খোলা হল তখন ভেতরে প্রভু নেই । চারদিকে প্রচার করা হয় তিনি জগন্নাথের সাথে লীন হয়ে গেছে । ভক্তজনের কাছে একথা বিশ্বাসযোগ্য হলেও প্রকৃত সত্য কি তাই ?
বহু ঐতিহাসিকের অনুমান নীলাচলে শ্রীচৈতন্যের প্রভাব জনপ্রিয়তা দেখে জগন্নাথ মন্দিরের পূজারীরা চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন । বহু মানুষ জগন্নাথদেবকে না দেখে শুধুমাত্র শ্রীচৈতন্যকে দর্শন করতেন । এতে ক্ষুব্ধ পূজারীর তাকে মন্দিরের মধ্যে হত্যা করে কোন গোপন পথে দেহ অন্যত্র সরিয়ে নিযে যায় । তাই বোধ হয় সাহিত্যিক কালকূট লেখেন-কোথায় গেলেন শ্রীচৈতন্য? কাদের হাতে তোমার রক্ত লেগে রইল ? আমরা কি সেই সব রক্তাত হাতে পূজার ডালি সাজিয়ে দেই ?