৯৮. রম্যাঁ রোলাঁ

৯৮. রম্যাঁ রোলাঁ

[১৮৬৬-১৯৪৪]

ফ্রান্সের বার্গান্ডী প্রদেশের একটি ছোট শহর ক্লামেসি। ১৮৬৬ সালের ২৯শে জানুয়ারি এই শহরেই জন্ম হয়েছিল সমান ফরাসী সাহিত্যিক মানবতার পূজারী রম্যাঁ রোলাঁর। জন্ম থেকেই ছিলেন রুগ্ন অসুস্থ। জীবনের কোন আশা ছিল না। কিন্তু মায়ের স্নেহ ভালবাসা যত্নে মৃত্যুকে জয় করলেন রোলা। কিন্তু রক্ষা করতে পারলেন না তাঁর কোলের মেয়েটিকে। দু বছর বয়েসে মারা গেল একমাত্র কন্যা। রোলাঁর বয়স তখন পাঁচ। প্রথম মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করলেন। নিজের জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, “আমার শৈশব যেন মৃত্যুর ছায়াঘেরা এক বন্দীশালা।”

রোলাঁ গান্ধীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তার কারণ গান্ধী যা চেয়েছিলেন তাই তিনি করতে পেরেছিলেন। তাই রোলাঁ বলেছেন তলস্তয় যেখানে ব্যর্থ গান্ধী সেখানে সফল।

এর পরবর্তীকালে তিনি আকৃষ্ট হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রতি। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হল তাঁর শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের জীবনী। রামকৃষ্ণের মধ্যে তিনি দেখেছিলেন অধ্যাত্ম সাধনা আর মানব প্রেমের এক সম্মিলিত রূপ। বিবেকানন্দের মধ্যে পেয়েছিলেন তাঁর কর্মের বাণী। একদিন যখন রোলাঁ প্রাচ্যের ধ্যানে মগ্ন, অন্যদিকে তখন তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন যুদ্ধরোত্তর ইউরোপের এক জীবন্ত চিত্র ‘বিমুগ্ধ আত্মা’ উপন্যাসে। এর প্রথম দুই খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে, তৃতীয় খন্ড ১৯২৬, চতুর্থ ১৯৩৩।

‘বিমুগ্ধ আত্মা’ রোলাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা জাঁ ক্রিসতফে রোলাঁ পূর্ণতা পাননি কিন্তু বিমুগ্ধ আত্মাতে এসে পেলেন পূর্ণতা। এই উপন্যাস জাঁ ক্রিসতফের চেয়ে অনেক পরিণত। এই কাহিনীর নায়িকা আনেৎ। সে এক শিল্পীর কন্যা। সুন্দরী, ধনী পরিবারে তার বিয়ে স্থির হল। কিন্তু বিয়ের ঠিক পূর্বে তার প্রেমিক বিয়ের মানসিকতার সাথে একমত হতে পারল না। আসলে সে চেয়েছিল স্বাধীনতা। পূর্ণ নারীত্ব। স্ত্রী হিসাবে দাসত্ব নয়। তখন সে সন্তানসম্ভবা। সন্তানের কথা ভেবেও সে বিয়ে করল না। নিজের সন্তান মার্ককে নিয়ে শুরু হল তার জীবন সংগ্রাম। আনেৎ যেন চিরন্তন নারী সংগ্রামের প্রতীক। দেশে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। তারই মধ্যে আনেৎ দেখেছে মানুষের কদর্য রূপ।

অবশেষে যুদ্ধ শেষ হল। আনেৎ নতুন যুগের স্বপ্ন দেখে। তার বিশ্বাস একদিন এই অন্ধকার পৃথিবী থেকে মানুষের সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই উত্তরণ ঘটবে। এই উপন্যাস শেষ হয়েছে সেই সংগ্রামের ডাক ‍দিয়ে। “ন্যায়পরায়ণ হওয়া তো ভাল কিন্তু প্রকৃত ন্যায়বিচার কি শুধু দাঁড়িপাল্লার কাছে বসে থাকে, আর দেখেই সন্তুষ্ট হয়? তাকে বিচার করতে দাও, সে হানুক আঘাত। স্বপ্ন তো যথেষ্ট দেখেছি আমরা, এবার আসুক জাগায় পালা।”

১৯১৯ থেকে ১৯২৯ রোলাঁর জীবনের এক যুগসন্ধিক্ষণ। একদিকে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা অন্যদিকে বাস্তব পৃথিবীর হাজার সমস্যা। ইউরোপের বুকে নতুন চিন্তা-ভাবনার উন্মেষ। তিনি উপলব্ধি করলেন গান্ধীবাদের আদর্শ যাকে একদিন তাঁর মনে হয়েছিল সমস্ত পৃথিবীকে পথ দেখাবে, ক্রমশই তার রং যেন ফিকে হয়ে আসছে।

ইউরোপের বুকে তখন ঘটে গিয়েছে রুশ বিপ্লব। এই নতুন আদর্শকে শ্রদ্ধার চোখে দেখলেও তাকে মেনে নিতে পারেনি তিনি। তাঁর অন্তরে তখন গান্ধী আর তলস্তয়। রুশ সাহিত্যিক গোর্কির সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল রোলাঁর। গোর্কিই তাঁকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক মতবাদের সাথে পরিচিত করালেন। প্রথমে সোভিয়েত সরকারকে মেনে নিতে না পারলেও ক্রমশই তিনি তার প্রতি  আকৃষ্ট হতে থাকেন। ১৯২৯ সালে যখন ফ্রান্সে কমিউনিস্টদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল, তাদের বন্দী করা হল, শ্রমিক শ্রেণীর উপর শুরু হল নির্যাতন, সেই সময় ফ্রান্সের কয়েকজন কবি দার্শনিক লেখক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়লেন।

রোলাঁ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কোন পথে তিনি যাবেন! প্রথমে তাঁর মনে হয়েছিল তিনি লেখক সাহিত্যিক, রাজনীতি তাঁর ধর্ম নয়। কিন্তু শেষে অনুভব করলেন যখন মানব জাতি বিপন্ন তখন সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠাই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি সমস্ত দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে নেমে এলেন রাজনীতির আঙিনায়, অনুভব করলেন মার্কসবাদের মধ্যেই মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিহিত। রচনা করলেন তাঁর “শিল্পীর নবজন্ম”। রোলাঁ লিখেছেন, “সমস্ত জীবন ধরে আমি যে পথের সন্ধান করেছি, সমাজতন্ত্রের মধ্যেই তার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি।”

রোলাঁ যখন এই মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন তখন তিনি ৭০ বছরের বৃদ্ধা। শুরু হল চারদিকে  প্রচার –রোঁলা কমিউনিস্ট…দেশদ্রোহী।

কিন্তু নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত রোঁলা শুধু ইউরোপ নয়, সমস্ত মানবের মুক্তির কামনায় মুখর হয়ে উঠলেন। “ভারতবর্ষ, চীন ইন্দোচীন প্রভৃতি শোষিত নিপীড়িত জাতির পাশে দাঁড়িয়ে আমি যুদ্ধ করব।”

১৯৩৬ সালে রোলাঁর ৭০তম জন্মদিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আড়ম্বর করে পালন করা হল। তাঁকে বলা হল ফ্রান্সের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান, মানব কল্যাণের এক অক্লান্ত যোদ্ধা।

জার্মানির ‍বুকে তখন  শুরু হয়েছে হিটলারের তান্ডব। রোলাঁ অনুভব করতে পারছিলেন আগামী দিন ইউরোপের বুকে এক প্রলয়ঙ্করী ঝড় নেমে আসছে।

১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর হিটলার পোলান্ড আক্রমণ করল। শুরু হল বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪০ সালে জার্মানরা ফ্রান্স দখল করল। রোলাঁ রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, সেটাই তাঁর শেষ চিঠি।

“আমি সংবাদপত্রে লিখতে পারছি না…তাই যৌবনের প্রথম সংগ্রামের দিনগুলিকে আমি পুনরায় জীবন্ত করে তুলছি, স্মৃতিকথা লিখছি।

অন্ধ হিংসা ও মিথ্যায় উন্মত্ত এই পৃথিবীতে আমাদের সত্য ও শান্তিকে রক্ষা করতেই হবে।”

রোলাঁ জীবনের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও নিজের গৃহ ছেড়ে কোথাও যাননি। তাঁর উপর তীক্ষ্ন নজর রাখা হত। তাঁর প্রতিটি ‍চিঠি পরীক্ষা করা হত, এমনকি তাঁকে খুনের হুমকি অবধি দেওয়া হত।

নিজের জন্যে কখনো চিন্তিত ছিলেন না রোলাঁ। মানুষের এই হত্যা নির্যাতন তাঁকে সবচেয়ে ব্যথিত করত। তাঁর মনে গ্যেটে বিঠোফেনের মহান দেশের এ অধঃপতন। একি সভ্যতার আসন্ন মৃত্যু!

এক বেদনার্ত হৃদয়ে নিঃসঙ্গভাবে সারাদিন নিজের ঘরে বসে   থাকতেন। নিজেকে প্রকাশ করা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। চারদিকে অনাহার অভাব। জার্মান দূতাবাস তাঁকে সব কিছু দিতে চেয়েছিল, খাদ্য কয়লা, পোশাক। কিন্তু হত্যাকারীর হাত থেকে কিছু গ্রহণ করতে তাঁর বিবেক বাধা দিয়েছিল। তাই জার্মানদের সমস্ত দানকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

অবশেষে ১৯৪৪ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ৭৮ বছর বয়সে যুদ্ধক্লান্ত পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্তেও বিশ্বাস হারাননি। নতুন যুগের মানুষকে ডাক দিয়ে বলেছেন-

“নতুন দিনের মানুষ, হে তরুণের দল, আমাদের পদদলিত করে তোমরা এগিয়ে চল। আমাদের চেয়েও বড় ও সুখী হও।”

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *