২৬.পাবলো নেরুদা
(১৯০৪-১৯৭৩)
আমি কোন সমালোচক বা প্রবন্ধকার নই। আমি সাধারণ কবি মাত্র। কবিতা ভিন্ন অন্য ভাষায় কথা বলা আমার পক্ষে অত্যন্ত কষ্ঠসাধ্য ব্যাপার।যদি আমাকে জিজ্ঞাসা কর আমার কবিতা কি? তাহলে বলতে হয় আমি জানি না। কিন্তু যদি আমার কবিতাকে প্রশ্ন কর সে জবাব দেবে, আমি কে”। যথার্থ অর্থেই তার কবিতার মধ্যেই তার জীবনের প্রকাশ। তার কবিতার মধ্যে ফুটে উঠেছে তার ভালবাসা, তার আশা- আকাঙ্খা, স্বপ্ন-আবেগ,তার আনন্দ,বেদনা,ক্রোধ,হতাশা আর সকলকে ছাপিয়ে তার তীব্র প্রতিবাদ।
এই প্রতিবাদের কবি, ভালবাসার কবির নাম পাবলো নেরুদা। নেরুদার আসল নাম নেফতালি রিকার্দো রেয়েজ বেসোয়ালতো। কিশোর বয়েসে যখন নেরুদা সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত হয়, সেই সময় চেকোশ্লোভাকিয়ায় ইয়ান নেরুদা বলে একজন বিখ্যাত লেখক ছিলেন।তার নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন পাবলো নেরুদা।
নেরুদার জন্ম চিলিতে (১২ জুলাই ১৯০৪)।দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে স্বাধীন দেশ চিলি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী মানুষ আর স্হানীয় উপজাতিরাই গড়ে তুলেছে এই দেশ। এখানে মিশ্র-ভাষা গড়ে উঠলেও সাহিত্যের ভাষা স্প্যানিশ।
নেরুদার বাবা ছিলেন সামান্য কিছু জমির মালিক,মা একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা।
নেরুদার জন্মের এক মাস পরেই মা টি.বি.তে মারা যান। বাবা আবার বিয়ে করলেন। নিজের মা না হলেও সৎ মা নেরুদাকে ভালবাসতেন নিজের সন্তানের মত।নিজের সন্তানের সাথে কোনদিন বিভেদ করেননি সৎ মা।
নেরুদার বয়স তখন দু বছর। দক্ষিণ চিলির সীমান্ত অঞ্ছলের জঙ্গল কেটে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে।
সংসারের আর্থিক অনটনের জন্য নেরুদার বাবা স্থির করলেন আরাউকো প্রদেশের সেই অরণ্য অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করবেন।সেখানে রেললাইন সংলগ্ন কাজ,রাস্তা তৈরির ঠিকাদারির কাজ নিলেন। এ এক সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ। চারদিকে ঘন সবুজ অরন্য।কোথাও অরন্য নির্মূল করে গড়ে উঠেছে চাষের ক্ষেত।সর্বত্রই এক আদিম বন্য প্রকৃতি। কোন ধর্মীয়, সামাজিক নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল নেই।মুক্ত অরণ্যের মতই মানুষের বেড়ে ওঠা। অরণ্যের নিত্য সঙ্গী হয়ে সারা বছর ঝরে পড়ে অবিশ্রাস্ত বৃষ্টি। শিশু নেরুদার জীবনে এই বৃষ্টি আর অরণ্যের,গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সকলের অজান্তেই তাঁর মধ্যে জেগে উঠেছিল এক কবি স্বত্তা। যখন তাঁর বয়স মাত্র দশ। তখনই শুরু হয় তাঁর কবিতা লেখা। শিশুমনের কল্পনায় যে ভাব জেগে ওঠে তাই লিখে ফেলেন। স্কুলে নিয়মিত পড়াশুনার সাথে সাথে বাইরের বই পড়ার নেশা জেগে ওঠে।এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ছেলেবেলায় আমি ছিলাম ঠিক যেন এক উটপাখি।কোন কিছু বাজবিচার না করেই আমি যা পেতাম তাই পড়ে ফেলতাম।
তেমুকোর পরিবেশ সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুকূল ছিল না। নেরুদার পিতার ইচ্ছা ছিল ছেলে বড় হয়ে যেন সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক অগ্রহী পুরূষ হয়ে ওঠে।তাই ষোল বছর বয়েসে নেরুদাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল শাস্তিয়াগোতে। সেই সময় কিশোর কবি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নেরুদা। তার সাহিত্য জীবনে স্থানীয় মেয়েদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের ভূমিকা বিরাট। মিস্ত্রাল শুধু চিলির নন,বিশ্বসাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি। তার অসামান্য সৃষ্ঠির জন্য নোবেল পুরাস্কার পান। মিস্ত্রাল নেরুদা মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ কবির সম্ভাবনাকে খেজে পেয়েছিলেন।তিনি শুধু তাকে ঊৎসাহিত করতেন তাই নয়। নিয়মিত তার কবিতা সংশোধন করে দিতেন।
১৯২১ সালে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নেরুদা এলেন সাস্তিয়াগোতে। চিলির অন্যতম প্রধান শহর। সাহিত্য-সংস্কৃতি কেন্দ্রস্থল।এখানে এসে ফরাসী ভাষা শিখতে আরম্ভ করলেন। কলেজে ভর্তি হলেন কিন্তু পড়াশুনায় তেমন মন নেই।কেমন ছন্নছাড়া ভাব।অল্পদিনের মধ্যেই কয়েকজন তরুণ কবির সাথে পরিচিত হলেন।তার কবিতা তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে আরম্ভ হয়েছে। এই সময়ের তিনি পিতৃ নাম পরিত্যাগ করে “পাবলো নেরুদা” এই ছদ্মনাম গ্রহণ করেন।
কবি হিসাব যখন সাহিত্যরসিকদের দৃষ্ঠি তার প্রতি আকৃষ্ঠ হচ্ছে, নেরুদা জীবনে এল এক সুন্দরী তরুণ আলবার্তিনা। দীর্ঘ দিন তার পরিচয় গোপন রেখেছিলেন নেরুদা।প্রথম প্রেমের মুকুল বিকশিত হয়নি।অল্পদিনের মধ্যেই দুজনের সম্পর্ক ভাঙন ধরন।জীবনে থেকে হারিয়ে গেলেও আলবার্তিনাকে কবি অমর করে রেখেছেন তার অসাধারণ সব প্রেমের কবিতায়। এই কবিতাগুলা নিয়ে ১৯২৪ সালে কূড়ি বছর বয়েসে প্রকাশিত হল Twenty Love poems.এর আগে আর একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছিলেন Twilight Book. সেই বইটি তেমন কোন সাড়া জাগাতে পারেনি।কিন্তু “কুড়িটি প্রেমের কবিতা” বইটি প্রকাশিত হতেই চারদিকে আলোড়ন পড়ে গেল। প্রচলিত ধারাকে অনুসরণ করলেও এর আঙ্কিক,ভাব,ভাষায় নিয়ে এলেন পরিবর্তন। আনন্দ-বেদনার সুরের মূর্চ্ছনা এতে এমনভাবে পরিস্ফূট হয়েছে সহজেই পাঠকের অন্তরকে স্পর্শ করে কবি হিসাবে তার খ্যাতি চারদিক ছড়িয়ে পড়ল।
১৯২৬ সালে প্রকাশিত হল দুটি রচনা। এক বন্ধুর সাথে যৌথভাবে একটি ছোট উপন্যাস। আর একটি কবিতার বই Venture of Infinite man-এর প্রতিটি কবিতায় প্রচলিত সমস্ত প্রথা ভেঙে নিয়ে এলেন নতুন আঙ্গিক,ছন্দ। মানব চরিত্রের এক অস্থিরতা,নিঃসঙ্গতাই এখানে যেন প্রকট হয়ে উঠেছে।সাধারণ মানুষ কিন্তু এই বইটিকে গ্রহণ করতে পারল না।
এদিকে ছেলে পড়াশুনা বন্ধ করে কবিতা লিখছে এই ব্যাপারটা ভাল লাগল না নেরুদার বাবার।তিনি সমস্ত মাসোহারা বন্ধ করে দিলেন। মহা ভাবনায় পড়ে গেলেন নেরুদা। তিনটি বই বার হলেও তার থেকে সামান্যই অর্থ পেয়েছেন। অর্থ ছাড়া কেমন করে নিজের খরচ মেটাবেন। পিতার কাছে হাত পাততে সায় দিল না ।শুরু হল চাকরির চেষ্ঠা। কয়েক মাস চেষ্ঠা করেও কোথাও চাকরি পেলেন না। সেই সময় চিলির বিদেশ দপ্তর থেকে রেঙ্গুন অফিসে পাঠাবার জন্যে একজন লোকের খোঁজ করা হচ্ছিল। কোন লোকই কয়েক হাজার মাইল দূরে বার্মায় রেঙ্গুন তখন ব্রিটিশ অধিনস্ত বার্মার রাজধানী। এখানে পরিচিত মানুষ নেই। স্থানীয় মানুষেরা স্প্যানিশ ভাষা জানে না।অফিসের দু-চারজন যেটুকু ভাঙা স্প্যানিশ জানে তাতেই কোন রকমের কথাবার্তা চালান।অসহনীয় পরিবেশ, কথা বলবার লোক নেই। তাঁর উপর সব মাসে ঠিক মত মাইনে পান না, তবুও রেগুনে রয়ে গেলেন।এই নির্জন প্রবাসে তাঁর একমাত্র সঙ্গি কবিতা।
চার বছর কেটে গেল। স্থানীয় ভাষা মোটামুটি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন নেরুদা।অনেক বার্মিজ পরিবারের লোকজনের সাথেই তাঁর আলাপ পরিচয় ছিল।এদের মধ্যে ছিল এক তরুণ।তার মধ্যেকার উদ্দামতা দেখে ভাল লেগে গিয়েছিল। প্রেমে পড়ে গেলেন। কিছু দিন যেতেই নেরুদা অনুভব করলেন মেয়েটির মধ্যে আছে এক আদিম বন্য উদ্দামতা। মনের মধ্যে যদি কখনো সন্ধেহ দেখা যায়, সাথে সাথে ছুরি দিয়ে হত্যা করবে নেরুদা। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন নেরুদা।সৌভাগক্রমে সেই সময় সিংহলে তাঁর বদলির আদেশ হল। কাঊকে কিছু না জানিয়ে রওনা হলেন সিংহাল। মেয়েটি নেরুদা সন্ধান পাওয়ার জন্যে সিংহাল পর্যন্ত গিয়েছিলেন।তার এই বন্য প্রেমকে নেরুদা বহু কবিতায় অবিস্মরণীয় রুপ দিয়েছেন। বার্মার জীবনের নিঃসঙ্গতাঁকে ভুলতে বেশ কিছু কবিতা
লিখেছিন। এই কবিতাগুলি সংকলন করেই পরে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ Residence on earth (পৃথিবীতে বাসা)।
সিংহলে অল্প কিছুদিন থাকার পর এলেন বাটাভিয়ায়।প্রবাস জীবনের একাধিক মেয়ের সান্নিধ্যে এলেও কাউকে বিবাহ করবার কথা ভাবেন্নি।বাটাভিয়াতে প্রথম ডাচ তরুণী মারিয়া এস্তোনিয়েতাকে দেখে বিবাহ করবার কথা মনে হল। একদিন সরকারি মারিয়াকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন।সম্মত হল মারিয়া। প্রথম কয়েক মাস সুখেই কেটা গেল।মারিয়া ডাচ মেয়ে,স্প্যানিশ ভাষা জানত না। নেরুদার চেষ্টা স্বত্তেও স্প্যানিশ ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর সামান্যতম আগ্রহ ছিল না।নেরুদার কবিতায় ব্যাপারও ছিল উদাসীন।দুজনের মধ্যেকার মতাদর্শগত পার্থক্য, দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। বাটাভিয়াতে থাকতে মন চাইল না, ফিরে এলেন তেমুকোতে বাবার কাছে। ছেলেবেলাতে দেখা তেমুকোর অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। সেই বনভূমি নির্জন প্রকৃতি আর নেই, সেখানে গড়ে উঠেছে শহর, কত অসংখ্য মানুষের আবাসস্থল। এখানকা্রে মানুষের সাথে বহুদিন যোগাযোগ নেই। নিজেকে যেন পরবাসী বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন।
সেই বন্ধী অবস্থায় ১২ দিন পর ২৩শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে মারা গেলেন। সামরিক শাসনের সমস্ত নিষেধ উপেক্ষা করে পথে বার হল লক্ষ লক্ষ মানুষ কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্য।স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সেই তাঁদের প্রথম প্রতিবাদ।