১৭.লুই পাস্তুর
(১৮২২-১৮৯৫)
প্যারিসের এক চার্চে একটি বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে । কন্যা পক্ষের সকলে কনেকে নিয়ে আগেই উপস্থিত হয়েছে । পাত্রপক্ষের অনেকেই উপস্থিত অ শুধু বর এখনো এসে পৌঁছাননি । সকলেই অধীর উৎকন্ঠায় অপেক্ষা করছে কখন বর আসবে । কিন্তু বরের দেখা নেই ।
চার্চের পাদ্রীও অধৈর্য হয়ে ওঠে । কনের বাবা পাত্রের এক বন্ধুর ডেকে বললেন,কি ব্যাপার, এখনো তো তোমার বন্ধু এল না ? পথে কোন বিপদ হল না তো ?
বন্ধু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল । দু-চার জায়গায় খোঁজ করল কিন্তু কোথাও বরের দেখা নেই । হঠাৎ মনে হল একবার ল্যাবরেটরিতে গিয়ে খোঁজ করলে হত । যা কাজপাগল মানুষ, বিয়ের কথা হয়ত একেবারেই ভুলে গিয়েছে ।
ল্যাবরেটরিতে গিয়ে হাজির হল বন্ধু । যা অনুমান করেছিল তাই সত্যি । টেবিলের সামনে মাথা নিচু করে আপন মনে কাজ করে চলেছে বর । চারপাশের কোন কিছুর প্রতিই তাঁর দৃষ্টি নেই । এমনকি বন্ধুর পায়ের শব্দেও তাঁর তন্ময়তা ভাঙে না । আর সহ্য করতে পারে না বন্ধু, রাগেতে চেঁচিয়ে ওঠে, আজ তোর বিয়ে, সবাই চার্চে অপেক্ষা করছে আর তুই এখানে কাজ করছিস !
মানুষটা বন্ধুর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, বিয়ের কথা আমার মনে আছে কিন্তু কাজটা শেষ না করে কি করে বিয়ের আসরে যাই ।
বিজ্ঞানের গবেষণায় উৎসর্গীকৃত এই মানুষটির নাম লুই পাস্তুর । ১৮২২ সালের ক্রীসমাস পর্বের দুদিন পর ফ্রান্সের এক ক্ষুদ্র গ্রাম জেলেতে পাস্তুর জন্মগ্রহণ করেন । বাবা যোসেফ পাস্তুর প্রথম জীবনে নেপোলিয়নের সৈন্যবাহিনীতে সৈন্যাধক্ষ হিসাবে কাজ করতেন । ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপেলিয়নের পরাজয়ের পর যোসেফ পাস্তুর প্রথম জীবনে নেপোলিয়নের সৈন্যবাহিনীতে সৈন্যাধ্যক্ষ হিসাবে কাজ করতেন । ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর যোসেফ পাস্তুর নিজের গ্রামে ফিরে এসে ট্যানারির কাজে যুক্ত হন । অল্প কিছুদিন পরেই স্বগ্রাম পরিত্যাগ করে আরবয় নামে এক গ্রামে এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস আরম্ভ করলেন । এখানেই ট্যানারির (চামড়া তৈরির কাজ) কারখানা খুললেন ।
যোসেফ কোনদিনই তাঁর পুত্র লুইকে ট্যানারির ব্যবসায়ে যুক্ত করতে চাননি । তার ইচ্ছা ছিল পুত্র উপযুক্ত শিক্ষালাভ করুক । কয়েক বছর স্থানীয় স্কুলে পড়াশুনা করবার পর যোসেফ পুত্রকে পাঠালেন প্যারিসের এক স্কুলে ।
গ্রামের মুক্ত প্রকৃতির বুকে বেড়ে ওঠা লুই প্যারিসের পরিবেশ কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলেন না । শহরের দমবন্ধ পরিবেশ অসহ্য হয়ে উঠত তাঁর কাছে । মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন । এই সময় একটা চিঠিতে লিখেছেন, “যদি আবার বুক ভরে চামড়া গন্ধ নিতে পারতাম, কয়েকদিনেই আমি সুস্থ হয়ে উঠতাম ।”
অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই ধীরে ধীরে শহরের নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন লুই । তাঁর গভীর মেধা অধ্যবসায় পরিশ্রম শিক্ষকদের দৃষ্টি এড়াল না । ছাত্রের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে স্কুলের প্রধাণশিক্ষক ভবিষৎবানী করেছিলেন, লুই পাস্তুর একজন কৃতি শিক্ষক হবে, তার সে ভবিষৎবাণী মিথ্যে হয়নি ।
আরপর তিনি ভর্তি হলেন রয়েল কলেজে । সেখান থেকে ১৮ বছর বয়সে স্নাতক হলেন । এই সময় নিজের কলেজেই তিনি একদিকে শিক্ষকতার কাজ শুরু করলেন, অন্যদিকে বিজ্ঞানে ডিগ্রী নেবার জন্য পড়াশোনা করতে থাকেন । মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞানে স্নাতক হলেন ।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে পাস্তুরের প্রিয় বিষয় ছিল রসায়ন । রসায়নের উচ্চতর শিক্ষা লাভ করতে আরম্ভ করলেন । দু’বছর পর মাত্র বছরে লুই পাস্তুর স্টাপবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক পদ গ্রহণের জন্য ডাক পেলেন । আনন্দের সঙ্গে এই পদ গ্রহণ করলেন পাস্তুর ।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর ছিলেন মর্সিয়ে লরেন্ট । তাঁর গৃহে নিয়মিত যাতায়াত করতে করতে রেক্টরের ছোট মেয়ে মেরির প্রেমে পড়ে যান । কয়েক সপ্তাহ পরেই রেক্টরের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন পাস্তুর । মঁর্সিয়ে লরেন্টও অনুভব করেছিলেন পাস্তুরের প্রতিভা । তাই এই বিয়েতে তিনি সানন্দে সম্মতি দিলেন ।
পাস্তুরও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন । ১৮৬৭ সালে তাঁকে সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের প্রধাণ অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত করা হল । এখানে এসে শুরু করলেন জীবাণু তত্ত্ব সম্বন্ধে গবেষণা । দু বছর ধরে চলল তাঁর গবেষণা । এই সময়ে ফ্রান্সের মুরগীদের মধ্যে ব্যাপক কলেরার প্রভাব দেখা দিল । পোলট্রি ব্যবসায়ের উপর বিরাট আঘাত নেমে এল । পাস্তুরের উপর রোগের কারন অনুসন্ধানের ভার পড়ল । নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পাস্তুর আবিষ্কার করলেন এক জীবাণুর । এবং এই জীবাণুই ভয়াবহ এনথ্রক্স রোগের কারণ এই এনথ্রক্স রোগ মাঝে মাঝে মহামারীর আকার ধারণ করত । গবাদি পশু-পাখি, শূয়র, ভেড়ার মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেত । পাস্তুর এনথ্রক্স রোগের সঠিক কারণ শুধু নির্ণয় করলেন না, তার প্রতিষেধক ঔষধও আবিষ্কার করলেন । রক্ষা পেল ফ্রান্সের পোলট্রি শিল্পী । বলা হত জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধে ফ্রান্সের যা ক্ষতি হয়েছিল, পাস্তুরের এক আবিষ্কার তার চেয়েও বেশি অর্থ এনে দিয়েছিল । পাস্তুরের এই আবিষ্কার, তাঁর খ্যাতি, সম্মান কিছু মানুষের কিছু ঈর্ষানীয় হয়ে ওঠে । তাঁরা নানা ভাবে তাঁর কুৎসা রটনা করত । কিন্তু নিন্দা প্রশংসা উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমান উদাসীন । একবার কোন সভায় পাস্তুর চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন । গুরিয়েন নামে ডাক্তার কিছুতেই মানতে পারছিলেন না একজন রসায়নবিদ চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা বিদ্যার উপদেশ দেবেন । নানাভাবে তাঁকে বিব্রত করতে লাগলেন । কিন্তু সামান্যতম ক্রুদ্ধ হলেন না পাস্তুর । রাগে ফেটে পড়লেন গুরিয়েন । সভা থেকে তাকে বার করে দেওয়া হল ।
পরদিন গুরিয়েন ডুয়েল লড়বার জন্য পাস্তুরকে আহ্বান করলেন । কিন্তু গুরিয়েনের সেই আহ্বান ফিরিয়ে দিলেন পাস্তুর, বললেন,আমার কাজ জীবন দান করা, হত্যা করা নয় ।
এতদিন শুধু কীটপতঙ্গ আর জীবজন্তুর জীবনদানের ওষুধ বার করেছেন । তখনো তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজটুকু বাকি ছিল । হাইড্রোফোবিয়া বা জলাতঙ্ক ছিল সে যুগের এক মারাত্মক ব্যাধি । এনথ্রক্স এর চেয়েও তা ছিল মারাত্মক । যখন কোন মানুষকে পাগলা কুকুরে কামড়াত, সেই ক্ষতস্থান সঙ্গে সঙ্গে বিষাক্ত হয়ে উঠত না । অধিকাংশ সময়েই সেই ক্ষত কয়েকদিনেই শুকিয়ে যেত । কয়েক সপ্তাহ পরেই প্রকাশ পেত সেই রোগের লক্ষণ । রুগী অবসন্ন হয়ে পড়ত । তেষ্টা পেত কিন্তু জলস্পর্শ করতে পারত না । এমনকি প্রবাহিত জলের শব্দ শুনেও অনেকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ত । দু-তিনদিন পরই মৃত্যু হত রোগীর ।
কয়েক বছর যাবৎ হাইড্রোফোবিয়া নিয়ে কাজ করছিলেন পাস্তুর । নিজের গবেষণাগারের সংলগ্ন এলাকায় পাগলা কুকুরদের পুষেছিলেন । যদিও কাজটা ছিল অত্যন্ত বিপদজনক সাহসের সাথেও সেই কুকুরদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন । একদিন এক বিশালদেহী বুলডগ কুকুর পাগলা হয়ে উন্মত্তের মত চিৎকার করছিল । তার মুখ দিয়ে ঝরে পড়ছিল বিষাক্ত লালা । তাঁকে বন্দী করে খাঁচায় পোষা হল । সেই খাঁচার মধ্যে দেওয়া হল একটা খরগোশকে । কিন্তু আশ্চর্য হলেন পাস্তুর । পাগলা কুকুরটি একটি বারের লালা খরগোশের দেহে প্রবেশ করানো একান্ত প্রয়োজন ছিল ।
গবেষণার প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিলেন পাস্তুর । বহু কষ্টে দড়ি বেঁধে ফেললেন সেই হিংস্র কুকুর । তারপর একটা টেবিলের উপর শুইয়ে মুখটা নিচু করলেন । তারপর মুখে রসামনে একটা কাচের পাত্র ধরলেন, টপ টপ করে তার মধ্যে গড়িয়ে পড়তে লাগল বিষাক্ত লালা । আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন পাস্তুর ঐ বিষাক্ত লালা দিয়েই তৈরি হল জলাতঙ্কের সিরাম ।
এবার পরীক্ষা শুরু হল । প্রথমে তা প্রয়োগ করা হয় খরগোশের উপর, তারপর অন্যান্য জীব-জন্তুর উপর । প্রতিবারই আশ্চর্য ফল পেলেন পাস্তুর । জীবজন্তুর দেহে তা কার্যকর হলেও মানুষের দেহে কিভাবে তা প্রয়োগ করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না পাস্তুর । কতটা পরিমাণ ঔষুধ দিলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে তার কোন সঠিক ধারণা নেই । সামান্য পরিমাণের তারতম্যের জন্য রোগীর প্রাণ বিপন্ন হতে পারে । সেক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য জেনেও সমস্ত দায় এসে বর্তাবে তাঁর উপর । কিভাবে এই জটিল সমস্যার সমাধান করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না পাস্তুর ।
অবশেষে অপ্রত্যাশিতভাবেই একটা সুযোগ এসে গেল । জোসেফ মিস্টার বলে একটি ছোট ছেলেকে কুকুরে কামড়েছিল । ছেলেটির মা তাকে এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল । ডাক্তার তাকে পাস্তুরের কাছে পাঠিয়ে দিলেন । পাস্তুর জোসেফকে পরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন তার মধ্যে রোগের বীজ সংক্রামিত হয়েছে । অল্পদিনেই মধ্যেই মৃত্যু অনিবার্য । পাস্তুর স্থির করলেন জোসেফের উপরেই তাঁর আবিষ্কৃত সিরাম প্রয়োগ করবেন । নয় দিন ধরে বিভিন্ন মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগ করতে লাগলেন পাস্তুর । একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে জোসেফ । তবুও মনের উৎকন্ঠা আর উদ্বেগ দূর হয় না । অবশেষে তিন সপ্তাহ পরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল জোসেফ । চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল পাস্তুরের আবিষ্কারের কথা । এক ভয়াবহ মৃত্যুর হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করলেন পাস্তুর ।
বৃষ্টিধারার মত চতুর্দিক থেকে তাঁর উপরে সম্মান বর্ষিত হতে থাকে । ফরাসী একাডেমীর সভাপতি নির্বাচিত হলেন তিনি ।
১৮৯২ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর পাস্তুরকে অভিনন্দন জানানোর জন্য দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা প্যারিসে জমায়েত হলেন । Antiseptic Surgery-র আবিষ্কর্তা জোসেফ লিস্টার বললেন, পাস্তুরের গবেষণা অস্ত্র চিকিৎসার অন্ধকার জগতে প্রথম আলো দিয়েছে । শুধুমাত্র অস্ত্র চিকিৎসা নয়, ঔষধ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও মানব সমাজ চিরদিন তাঁর কাছের ঋণী হয়ে থাকবে ।
দেশ-বিদেশের কত সম্মান, উপাধি, পুরস্কার, মানপত্র পেলেন । কিন্তু কোন কিছুতেই বিজ্ঞান সাধক পাস্তুরের জীবন সাধনার সামান্যতম পরিবর্তন ঘটেনি । আগের মতেই নির অহঙ্কার সরল সাদাসিদা রয়ে গেলেন ।
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সম্মেনের সভাপতি । তিনি এগিয়ে এসে পাস্তুরকে বললেন, এই সংবর্ধনা যুবরাজের জন্য নয়, এ আপনারই জন্য ।
প্যারিসে ফিরে এলেন পাস্তুর, তাঁর সম্মানে গড়ে উঠেছিল পাস্তুর ইন্সটিউট – এখানে সংক্রামক রোগের গবেষণার কাজ চলছিল ।
পাস্তুর অনুভব করতে পারছিলেন তাঁর দেহ আর আগের মত কর্মক্ষম নেই । মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন । সকলের অনুরোধে কর্মজীবন থেকে অবসর নিলেন । এই সময় বাইবেল পাঠ আর উপাসনার মধ্যেই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটতেন । তবুও অতীত জীবন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন নি । মাঝে মাঝেই তাঁর ছাত্ররা তাঁর সাক্ষাৎ করতে আসত । তিনি বলতেন তোমরা কাজ কর, কখনো কাজ বন্ধ করো না ।
তাঁর সত্তরতম জন্মদিনে ফ্রান্সে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করা হল । সোরবোনে তাঁর সম্মানে বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল । দেশ-বিদেশের বহু বিজ্ঞানী সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন । এরপর আরো তিন বছর বেঁচে ছিলেন পাস্তুর । অবশেষে ১৮৯৫ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বর চিরনিদ্রায় ঢলে পড়লেন বিজ্ঞান-তপস্বী লুই পাস্তুর । যাঁর সম্বন্ধে তৃতীয় নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ফ্রান্সের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান ।