২০. জন কিটস
(১৭৯৫-১৮২১)
দুশো বছর আগেকার কথা । লন্ডন শহরের প্রাণকেন্দ্রে ছিল একটি আস্তাবল । এমনি একটি আস্তাবলের পরিচালক ছিলেন টমাস কিটস্ । নিচে আস্তাবল, উপরে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন টমাস । স্ত্রী আস্তাবলের মালিকের মেয়ে । কাজের প্রয়োজনে টমাসকে যেতে হত মালিকের বাড়িতে । সেখানেই দুজনের দেখা,তারপরে প্রেম, একদিন বিবাহ ।
বিবাহের এক বছর পর ১৭৯৫ সালের অক্টোবর মাসে টমাসের প্রথম সন্তানের জন্ম হল । যথাসময়ে শিশুর নামকরণ করা হল জন কিটস্ ।
কিটসের জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম হল তাঁর দুই ভাই জর্জ আর টমের । তিন ভাইয়ের মধ্যে কিটস ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর ।
সাত বছর বয়েসে তাঁকে এনফিল্ডের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল । কিটসের তখন নয় বছর বয়েস। জীবনে প্রথম আঘাতের মুখোমুখি হলেন । ঘোড়া থেকে পড়ে মারা গেলেন টমাস কিটস্ ।
স্বামীর মৃত্যুর পর কিটসের মা রলিগুস নামে একজনকে বিয়ে করলেন । কিন্তু অল্পদিনেই দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরল । এক বছরের মধ্যেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল । ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি এলেন কিটসের মা । কিটস তখন দশ বছরের ছেলে ।
১৮১০ সালে মারা গেলেন কিটসের মা । মরবার আগে নিজের অজান্তেই রাজরোগ যক্ষ্মার বীজ দিয়ে গেলেন সন্তানকে ।
মায়ের মৃত্যুর পর পিতৃ-মাতৃহীন ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিলেন মিস্টার এ্যাবি । স্কুলে ফিরে এলেন কিটস্ । দিন রাত পড়াশুনা নিয়ে থাকেন মাঝে মাঝে মনের খেয়ালে কবিতা লেখেন ।
১৫ বছর বয়েসে স্কুলের পড়া শেষ হল । কিটসের অভিভাবকের ইচ্ছা কিটস ডাক্তারি পড়বেন।
ডাক্তারি পড়বার জন্যে ভর্তি হলে মেডিকেল কলেজে । কিন্তু যাঁর মনের মধ্যে জেগে উঠেছে কবিতার নেশা, হাসপাতালের ছুরি কাঁচি ঔষধ রুগী তাঁর ভাল লাগবে কেন । সৌভাগ্য সেই সময় তাঁর স্কুলের বন্ধু কাউডেন ক্লার্ক কিটসকে নিয়ে গেলেন সেই সময়কার খ্যাতিমান তরুণ কবি লে হান্টের কাছে ।
হান্টের সাথে পরিচয় (১৮৬১) কিটসের জীবনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা । হান্ট কিটসের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলেন, তাঁকে আরো কবিতা লেখবার জন্যে উৎসাহিত করলেন ।
হান্ট একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন । সেই পত্রিকাতেই কিটসের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হল । এখানে কিটসের পরিচয় হল শেলীর সাথে । এখানে কিটসের পরিচয় হল শেলীর সাথে ।
আর ডাক্তারির মোহে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারলেন না । অভিভাবকের উপদেশ অগ্রাহ্য করে মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দিয়ে স্থির করলেন সাহিত্যকেই জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন।
কিটস্ তাঁর দুই ভাইকে নিয়ে লন্ডন ত্যাগ করে এলেন হ্যাম্পস্টেডে । এখানে আসবার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হান্টের সঙ্গ পাওয়া ।
অল্পদিনের মধ্যে কিটস্ প্রকাশ করলেন তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন । সকলের মনে আশা ছিল এই বই নিশ্চয়ই জনপ্রিয় হবে । কিন্তু দুভার্গ্য কিটসের, পরিচিত কিছু লোকজন ছাড়া এই বই-এর একটি কপিও বিক্রি হল না ।
প্রথম কাব্য সংকলনের ব্যর্থতায় সাময়িক আশাহত হলেন কিটস্ কিন্তু অল্পদিনেই নতুন উৎসাহে শুরু করলেন কাব্য সাধনা । লেখা হল প্রথম দীর্ঘ কবিতা এন্ডিমিয়ন । এ এক অসাধারণ কবিতা । এই কবিতার প্রথম লাইনের মধ্যেই কিটসের জীবন দর্শন ফুটে উঠেছে ।
A thing of beauty is joy forever.
ইতিপূর্বে কখনো দেশভ্রমণে যাননি কিটস্ তাই বন্ধুর সাথে বেরিয়ে পড়লেন । ভ্রমণ শেষ করে ফিরে আসতেই দেখলেন তাঁর ভাই টম গুরুতর অসুস্থ ।
প্রকাশিত হল তাঁর এন্ডিমিয়ন(১৮১৭) । কিটস্ আশা করেছিলেন তাঁর এই কবিতা নিশ্চয়ই খ্যাতি পাবে । কিন্তু তৎকালীন দুটি পত্রিকা ব্ল্যাকউড ম্যাগাজিন এবং কোয়াটার্লি রিভিয়ু তীব্র ভাষায় কিটসের নামে সমালোচনা করল । জঘন্য সে আক্রমণ । এই তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনা প্রকৃতপক্ষে কিটসের মানসিক শক্তিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল ।
একদিকে যখন পত্রিকার সমালোচনায় ভেঙে পড়েছেন কিটস্ । সেই সময় এল আরেক আঘাত । ১৮১৮ সালের ১ লা ডিসেম্বর মারা গেল টম ।
কিটস স্থির করলেন যেমন করেই হোক তাঁকে অর্থ উপার্জন করতেই হবে । স্বাস্থ্য আগের মত ভাল যাচ্ছিল না । কিন্তু মনের অদম্য শক্তিতে কিটস্ লিখে চললেন একের পর এক কবিতা । প্রকৃতপক্ষে কিটসের জীবনের সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিতাই এক সময়ে লেখা ।
আর্থিক অবস্থাও ভাল যাচ্ছিল না কিটসের । কিটসের শরীর যতই ভেঙে পড়ছিল ততই ফ্যানি তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল । তার সাজ-গোজ হাসি অন্য ছেলেদের সাথে মেলামেশা কিটস্ সহ্য করতে পারতেন না । তাঁর সমস্ত অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত ।
তিনি ফিরে এলেন লন্ডনে । একদিন বাইরে বেড়াতে বেরোলেন কিটস । বাড়িতে ফিরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল, সেই সাথে কাশি । এক ঝলক রক্ত উঠে এল মুখ দিয়ে । কিটস্ বললেন, একটি মোমবাতি নিয়ে এস । ব্রাউন মোমবাতি নিয়ে আসতেই কিটস্ কিছুক্ষণ রক্তের দিকে চেয়ে বললেন, এই রক্তের রং আমি চিনি, এই রক্ত উঠে আসে ধমনী থেকে । এই রক্ত আমার মৃত্যুর শমন । ডাক্তার এল । সে যুগে যক্ষ্মার কোন চিকিৎসা ছিল না । প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে শিরা কেটে কিছুটা রক্ত বার করে দেওয়া হল । কিন্তু তাতে কোন সুফল দেখা গেল না ।
তখন তাঁর বয়স মাত্র পঁচিশ । গলার স্বর ভেঙে গিয়েছিল, মাঝে মাঝেই জ্বর হত, গলা দিয়ে রক্ত উঠে আসত, এই সময় তাঁর সৃষ্টির উৎসও ফুরিয়ে আসছিল ।
এই সময় প্রকাশিত হল কিটসের তৃতীয় ও শেষ কাব্য সংকলন (১৮২০) । এই কবিতাগুচ্ছ কিটস্ কে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের পাশে স্থান দিয়েছে ।
এই সংকলনে একদিকে ছিল কিছু বড় কবিতা অন্যদিকে ছোট কিছু কবিতা, সনেট । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইসাবেলা ( Isabella or the pot of Basil 1818)। Hyperion- গ্রীক পুরাণের কাহিনী অবলম্বন করে লেখা দীর্ঘকাব্য ।
The Eve of St, Agnes ( 1818)- ইভ অব সেন্ট অ্যাগানিস ।
কিটসের আরেকটি বড় কবিতা The Eve of Saint Mark………. এটিও অসমাপ্ত ।
এই সব দীর্ঘ কবিতার পাশাপাশি রচিত তাঁর ছোট কবিতা (Ode) গুলির মধ্যে ফুটে উঠেছে এক অনন্য সৌন্দর্য ।
এই ছোট কবিতাগুলির মধ্যে আছে । Ode to a Nightingale, Ode on a Grecian urn, Ode on Melancholy, Ode to Autumn.
Ode to Nightingale- এ মানব জীবনেরই এক রূপক । এখানে জীবন মৃত্যুর স্রোত পাশাপাশি বয়ে চলেছে ।
Ode to Autumn- এ এক বিপরীত ধরণা ফুটে উঠেছে, এখানে কবি প্রকৃত সৌন্দর্য খুঁজে বেরিয়েছেন ।
কবিতা ছাড়া কিটস্ কোন গদ্য লেখার চেষ্টা করেন নি । তাঁর কাব্য জীবন ছিল মাত্র ছয় বছর (১৮১৪-১৮১৯) । অর্থাৎ উনিশ থেকে চব্বিশ বছর বয়স । ১৮২০ সাল । কিটসের দেহ ক্রমশই ভেঙে পড়ছিল । তাঁকে নিয়ে আসা হল ফ্যানিদের বাড়িতে । ইটালিতে যাবার আগে এক মাস তিনি ফ্যানির নিবিড় সান্নিধ্যে পেয়েছিলেন ।
১৮২০ সালের ১৩ ই সেপ্টেম্বর কিটস্ রওনা হলেন ইটালির দিকে । দীর্ঘ সমুদ্র পথ পার হতে ছয় সপ্তাহ লাগল । জাহাজে যেতে যেতে কিটস্ মুক্ত আকাশের দিকে চেয়ে থাকতেন । চোখে পড়ত ধ্রুবতারা । মনে হত মৃত্যুর পর তিনি ঐ ধ্রুবতারার সাথে একাত্ম হয়ে যাবেন ।
২৩ শে ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ১৯২১ সাল । সমস্ত দিন কেমন আচ্ছন্ন ছিলেন কিটস্ রাত তখন প্রায় এগারোটা, মাথায় পাশে বসেছিল বন্ধু সেভার্ন । আস্তে আস্তে কিটস্ বললেন “ আমাকে তুলে ধর, আমার মৃত্যু এগিয়ে এসেছে । আমি শান্তিতে মরতে চাই, তুমি ভয় পেও না- ইশ্বরকে ধন্যবাদ, অবশেষে মৃত্যু এল।” সেভার্নের কোলেই চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন চিরসুন্দরের কবি কিটস্ । পরদিন রোমের এক সমাধিক্ষেত্রে তাঁকে সমাধি দেওয়া হল ।
দু-বছর পরে এই সমাধিক্ষেত্রেই সমাধি দেওয়া হয় আরেক তরুণ কবি শেলীকে ।