৬০.জোহান্স গুটেনবার্গ
[১৪০০-১৪৬৮]
মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার হিসাবে জোহান্স গুটেনবার্গ নাম কে না জানে।এই জার্মান বৈজ্ঞানিক পৃথিবী বিখ্যাত। ১৪০০ সালে জার্মানের এক ভদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম।ছোটবেলায় ভালভাবে লেখাপড়া শেখার সুযোগ তেমন পাননি তিনি। তাই বাবার ব্যবসাকেই সঙ্গী করে জীবন শুরু করেন।গুটেনবার্গ ছিলেন একজন খুব ভাল শিল্পী।ব্যবসায়েও খুব ভাল ছিলেন। বাজারে তাঁর সুনাম ছিল সৎ ব্যবসায়ী।
গুটেনবার্গের একটা নেশা ছিল তখন খেলায়। তিনি অবসর সময়েই পেলেই তাঁর স্ত্রী এনার সঙ্গে তাস খেলতে বসে যেতেন।আজকের মতো তখতো ভাল তাস পাওয়া যেত না, তাই শিল্পীরাই মোটা কাগজ কেটে তাঁর উপর তাঁসের ছবি আঁকতেন। তখনি তাস খেলতে খেলতে গুটেনবার্গের মাথায় একটাবুদ্ধি এল।তিনি ভাবলেন দূর খুব সুন্দর করে এক বান্ডিল তাঁস আঁকবেন।ব্যস্ এই কথা মনে হতেই তিনি খেলা বন্ধ করে মেতে গেলেন তাঁস আঁকতে।
দুই তিন খানা ছবি আঁকার পরই তিনি ভাবলেন দূর এইভাবে এত কষ্ট করে আঁকা যায়? কিভাবে যন্ত্রের দ্বারা ছবি আঁকা যায় সেই ভাবনাই ভাবতে লাগলেন।গুটেনবার্গ রং তুলি ফেলে তিনি গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসলেন। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তিনি কাঠের ব্লক তৈরি করলেন। সেই কাঠের ব্লকের উপর কালি মাখিয়ে তা কাগজের উপর ছাপ দিলেন।এতে সত্যিই সুন্দর তাসের ছবি পাওয়া গেল।আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন গুটেনবার্গ। তিনি অনেকগুলো কাঠের ব্লক তৈরী করে প্রচুর তাস তৈরি করে সব বন্ধুদের আনন্দে বিলাতে লাগলেন।
কাঠের ব্লকে তাস ছেপে তিনি খুব খুশি হলেন।শিল্পীমানের চিন্তার শেষ নেই।এবার ভাবলেন অন্যকিছু।গুটেনবার্গ মনে মনে ঠিক করলেন কাঠের উপর মহাপুরুষের ছবি এঁকে ব্লক করলে কেমন হয়? যেই ভাবা সঙ্গে সঙ্গে তিনি কাজে লেগে গেলেন।এই মহাপুরুষের ছবির নিচে কাঠের সূক্ষ্ম এবং ধারাল অস্ত্র দিয়ে কেটে কেটে অক্ষরের ব্লক তৈরী করে মহাপুরুষের সংক্ষিপ্ত জীবন কথা ছেপে দেবার ব্যবস্থা করলেন।
এভাবে তিনি বেশ কয়েকজন মহাপুরুষের ছবি তৈরী করে দোকানের রেখে দিলেন।গুটেনবার্গের দোকানের অনেক ভাল ভাল লোকজন আসতেন, তারা তাঁর এই গুন দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন।অনেকে অনেক দাম দিয়ে ছবিগুলো কিনে নিলেন।হাতের কাছে ব্লক তৈরি থাকার জন্য গুটেনবার্গ অল্প সময়ের মধ্যে সাদা কাগজে ছাপ দিয়ে ছবি তৈরি করে বিক্রি করতেন।প্রথমে তিনি কাঠের ফলকে ছবি ও লেখা এঁকে ফেলতেন তারপর প্রয়োজনমত অংশটা রেখে বাকি কাঠটা কেটে ফেলতেন।
এই সোজা ব্লকটা আর একটা কাঠের ফলকে ছাপ দিয়ে উল্টো ব্লক তৈরি করে নিতেন। এই পরের ব্লকটাই হতো কিন্তু আসল ব্লক।
একদিকে গুটেনবার্গের দোকানে এক পাদরী সাহেব এলেন তিনি গুটেনবার্গের এই কান্ড দেখে তো অবাক হয়ে গেলেন।তিনি বেশ কয়েকটা ছবি কিনে নিলেন। পাদরী সাহেব ভাবলেন তা মহাপুরুষের জীবনী যদি আর একটা বড় করে লিখে জনসাধারণের মধ্যে বিলি করা যায় তাহলে দেশের মানুষের জীবনী লিখে নিয়ে হাজির হলেন গুটেনবার্গে কাছে, তিনি বললেন যেমন করে হোক এই গুলা ছাপিয়ে দিতে হবে, তার জন্য যা খরচ হবে সব তিনিই দেবেন।
গুটেনবার্গ তো মহা বিপদ পড়লেন। ভাবলেন কি করে এই সমস্যার সমাধান করবেন। তবে মুখে কিছুই বললেন না। কয়েক মাস ধরে তিনি অসম্ভব পরিশ্রম করে
কাঠের ফলকের উপর একটার পর একটা করে খোদাই করলেন অক্ষরের উল্টো প্রতিলিপি। এভাবে তিনি চৌষট্টিখানা ব্লক তৈরি করে একদিন প্রকাশ একদিন প্রকাশ করলেন চৌষট্টি পৃষ্টার মহাপুরুষের জীবনী গ্রন্থ। যা সবাইকে অবাক করে দিল।কারণ এর আগে কোন বই ছাপা অক্ষরে বের হয়নি।পৃথিবীতে এটাই হচ্ছে প্রথম ছাপা বই।
এই বইটির ছাপার পর থেকে গুটেনবার্গের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। তিনি ঠিক করলেন এবার বাইবেল ছাপাবেন।তিনি,তাঁর স্ত্রী এনা ও আরও কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে আরম্ভ করলেন কাজ কিন্তু কাজ আরম্ভ করার মুখেই ঘটল এক বিপদ।সবেমাত্র কয়েক পৃষ্টার ব্লক তৈরী হয়েছে তা পরীক্ষা করতে গিয়ে হাত ফসকে ব্লকগুলো পড়ে গেল।ব্যস সঙ্গে সঙ্গে ওগুলো ভেঙ্গে গেল।কারণ এই ব্লক গুলো ছিল খুবই পাতলা কাঠের। এই ঘটনায় গুটেনবার্গ খুবই হতাশ হয়ে পড়লেন।তবুও আশা ছাড়লেন না। ভাবলেন এমন একটা উপায় বার করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আর এমটি না ঘটে।কিভাবে এই কাজ করা যায়? এই ভাবতে ভাবতে গুটেনবার্গের এক নতুন চিন্তা মাথায় এল ।তিনি এবার কাঠের উপর অক্ষর খোদাই না করে কেবল কাঠের অক্ষর তৈরি করতে শুরে করলেন। অনেক অক্ষর তৈরি করে এবার কাঠের ফলকে লেখার মতো সাজিয়ে ছিলেন। তারপর তাতে কালি মাখিয়ে কাগজের উপর ছাপ দিলেন ।গুটেনবার্গ দেখলেন এতেই ছাপার কাজের সুবিধে বেশি।
এবার তিনি এই কাঠের অক্ষরগুলির নাম দিলেন টাইপ।কাঠের টাইপ কয়েকবার ছাপ দেওয়ার পর তোঁতা হয়ে যায় বলে পরের দিকে তিনি ধাতুর তৈরি টাইপ ব্যবহার করতেন।১৪৫০ সালে গুটেনবার্গ টাইপ আবিষ্কার করেন,তারপরই বাইবেল ছাপা হয়।
যে বিজ্ঞানী এত বিস্ময়কর জিনিস আবিষ্কার করলেন, তার জীবনের কিন্তু অভাবে কাটেনি।কারণ তাঁর ও তাঁর স্ত্রী এনার ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল না। কারণ ব্যবসায়ী বুদ্ধি থাকলে ওদের অনাহারে কাটাতে হতো না। তাঁরা ইচ্ছে করলে বাইবেল ও অন্যান্য বই ছেপে প্রচুর আয় করতে পারতেন।গুটেনবার্গ তার নিজের সবকিছু দিয়ে করেছিলেন এই ছাপা খানা।শেষ বয়সটা তাঁর খুবই কষ্টে কাটে। কারণ তাঁর স্ত্রী এনা মারা যাবার পর তিনি আরও ভেঙ্গে পড়েন। কাজের যে উৎসাহ সেটাও তাঁর কমে যায়।সেই সময় পাদরী সাহেব দয়া করে তাঁকে অল্পকিছু টাকার পেনসনের ব্যবস্থা করে দেন। সেই পেনসনের উপর নির্ভর করেই তিনি বাকি জীবনটা কাটান।
গুটেনবার্গেন কাঠের টাইপ আজও বিজ্ঞান জগতে এক শ্রেষ্ঠ অবদান।তা সময়ে চৌষট্টি পৃষ্ঠার জীবনীগ্রন্থ ও বাইবেলকেও বিস্ময়কর ঘটনা ছাড়া ভাবা যায় না। এই বিজ্ঞানী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৪৬৮ সালে।
আজ পৃথিবীতে ছাপাখানার অনেক আধুনিক উন্নতি হয়েছে।১৮৮৬ সালে ওটসার মারগেন থ্যাসার নামে এক আমেরিকান যন্ত্রবিদ লাইনো পাইপ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। পরে অবশ্য মনোটাইপ অফটেস আবিষ্কার হয়ে মুদ্রণ শিল্পকে উন্নত হয়েছে। তবে গুটেনবার্গ হচ্ছে মুদ্রণ শিল্পের প্রথম ও প্রধান জন্মদাতা।