৪৭. জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল

James-Clerk-Maxwell

৪৭. জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল
[১৮৩১-১৮৭৯]

চুম্বক,তড়িৎ ও তড়িৎ চুম্বক তরঙ্গতত্ত্বের উপর যার গবেষণা এককালে একটা প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল,সেই বিজ্ঞানের নাম জেম্স ক্লার্ক মাক্সওয়েল। তড়িৎ বিজ্ঞানে তিনি যে সূত্রটি আবিষ্কার করেছিলেন সেই সূত্রটি “ ম্যাক্সওয়েলের কর্ক স্ক্রু সূত্র” নামে প্রসিদ্ধ। এই সূত্রের সাহায্য তড়িৎপ্রবাহের ফলে চুম্বক শলাকার দিক নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

ম্যাক্সওয়েল পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করেন,পরিবাহী তারের মধ্যদিয়ে যে দিকে তড়িৎপ্রবাহ চালনা করা হয়-উদাহরণস্বরুপ একটি ডানপাকের স্কর্ক স্ক্রুকে পরিবাহী তার বরাবর সেই দিকে ঘোরান হলে হাতের বুড়ো আঙুলটি যে দিকে ঘুরে চুম্বক শলাকার উত্তর মেরু সেই দিকে বিক্ষিপ্ত হয়। ম্যাক্সওয়েলের এই আবিস্কারটি তড়িৎ বিজ্ঞানে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

ম্যাক্সওয়েল যে আবিষ্কাটিকে যুগান্তকারী অ্যাখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে সেটি তড়িৎচুম্বক তরঙ্গতত্ত্ব।প্রকৃতপক্ষে উক্ত তরঙ্গতত্ত্ব সম্বন্ধে প্রথম সঠিক ধারণা দিয়েছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে অথবা চুম্বক ক্ষেত্রে সামান্যতম বিশৃঙ্খলা ঘটলেই আলোর গতির সমান একটি তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ বেরিয়ে আসে। ঐ তরঙ্গের ধর্মও সাধারণ আলোর ধর্মের মতই অর্থাৎ আলোকের মত ওদেরও হয় প্রতিফলণ,প্রতিসারণ পোলারাইজেশন প্রভূতি।

জেম্স ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ১৮৩১ খ্রীস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর এনিবার জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা ছিলেন  একজন প্রখ্যাত আইনজীবী।তবুও বিজ্ঞানের প্রতি ছিল তাঁর অনুরাগ।তাই চেয়েছিলেন,পুত্র তিনি বিজ্ঞান পড়াবেন।

ম্যাক্সওয়েল লেখাপড়ায় যথেষ্ট সুব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর পিতা। এমন কি অবসর সময়ে নিজেই বসতেন ছেলেকে পড়াতে। একমাত্র পুত্র ছিলেন বলে হয়ত পিতার স্নেহের মাত্রা একটু বেশিই ছিল।তথাপি পুত্রের উন্নতির জন্য শাসন করতেও কুষ্ঠিত হতেন না ।

মাত্র ষোল বছর বয়েসে ম্যাক্সওয়েলের উদ্ভাবনী শক্তি দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন পিতা। যে কয়েকটি যন্ত্র নিমার্ণ করেছিলেন ম্যাক্সওয়েল, সেগুলি পিতা একদিন দেখত দিলেন তৎকালীন একজন নামকরা বিজ্ঞান “ফোরবীজ’কে । ফোরবীজ সেগুলি দেখে বালকের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং প্রেরণ করেন লন্ডনের রয়েল সোসাইটিতে।শোনা যায়,রয়েল সোসাইটিও ম্যাক্সওয়েলের প্রশংসা করে সার্টিফিকেট প্রদান করেছিলেন।

সতের বছর বয়েসের সময় ম্যাক্সওয়েলের এভিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন।পাশ করার পর উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষাণাগারে বেশ কিছুদিন চুম্বক ও তড়িৎ সম্বন্ধে গবেষণা করেন। অতঃপর উন্নততর গবেষণার জন্য তিনি যোগদান করেন কেব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়।এইখানে ১৮৫১ খ্রীস্টব্দে তিনি আবিষ্কার করেন তাঁর প্রসিদ্ধ “কর্ক স্ক্রু সূত্রটি”। কথিত আছে,কেম্ব্রিজে অবস্থানকালে ম্যাক্সওয়েল তৎকালীন ইংল্যান্ডের সেরা বিজ্ঞানী ফ্যারাডের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন এবং তাঁরই অনুপ্রেরণায় তড়িৎচুম্বক সম্বন্ধে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

ম্যাক্সওয়েল কেবলমাত্র পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন না, অঙ্কশাস্ত্রে এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানেও ছিল তার সমান দক্ষতা।তাঁর বহুমুখী প্রতিভার জন্য ১৮৬০ খ্রীষ্টব্দে কিংস কলেজ তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় এবং ম্যাক্সওয়েল গ্রহণ করেন এখানকার পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার প্রধান অধ্যাপকের পদ।

কিংস কলেজ অধ্যাপনাকালে ১৮৬৪ খ্রীষ্টব্দে ম্যাক্সওয়েল আবিষ্কার করেন আলোকের তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গতত্ত্ব।

ম্যাক্সওয়েল বড় গণিতজ্ঞ ছিলেন বলে উক্ত তরঙ্গতত্ত্বের ধারণা করা সম্ভব হয়েছিল তাঁর।অবশ্য তৎকালীন বিজ্ঞানীদের ইথার ও আলোক তরঙ্গের ধারণা,বিদ্যু কারেন্ট চৌম্বক ক্ষেত্র প্রভূতি থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন তিনি। পরে আলোক তরঙ্গকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সহজ গণিতের পরিবর্তে উচ্চ গণিতের দুটি শাখা ‘ভেক্টর ও ক্যালকুরাস” প্রয়োগ করেছিলেন।ম্যাক্সওয়েলের মতবাদতে সেদিন বিজ্ঞানীরা  সোজাসুজি মেনে নিতে পারেন নি।

চারদিক থেকে উঠেছিল বর তর্কের ঝড়।শেষে সব তর্কের হয় অবসান । ম্যাক্সওয়েলের নাম ছড়িয়ে পড়ে বিজ্ঞানজগতে। এবার আমন্ত্রণ এল কেব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।তিনিও কিংস কলেজ পরিত্যাগ করে যোগদান করেন কেম্ব্রিজ।

ম্যাক্সওয়েল কিছুকাল জ্যোতিবিজ্ঞান সম্বন্ধেও গবেষণা করেছিলেন। একদা শনিগ্রহের বলয় সম্বন্ধে লেখা তাঁর একটি প্রবন্ধ চারদিকে আলোড়ন তুলেছিল এবং উক্ত প্রবন্ধটির জন্য তিনি লাভ করেছিলেন   “এডমস পুরস্কার”

কতকগুলি মূল্যবান গ্রন্থেরও রচয়িতা ম্যাক্সওয়েল।গ্রন্থগুলি মধ্যে “তাপতত্ত্ব” এবং পদার্থ গতি” নামক  দুখানি গ্রন্থ বিজ্ঞানীদের কাছে বেশ পরিচিত।তাছাড়া ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত “ ট্রিটিজ অন ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজম” নামক গ্রন্থটি তাঁর অসামান্য প্রভিবার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।

ম্যাক্সওয়েলের জীবনের একটি বড় কীর্তি লন্ডনে “ ক্যাভেন্ডিস ল্যাবোরেটরি” নামক বিখ্যাত গবেষণারটির সুনাম বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।

অত্যাধিক পরিশ্রমের ফলে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে ম্যাক্সওয়েলের। চল্লিশ বছর বয়স অতিক্রমের পরই তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তবুও গবেষণা এবং পুস্তক রচনায় ভাটা পড়েনি। অবশেষে সুদীর্ঘকাল রোগভোগের পর ৪৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেদিনটি ছিল ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই নভেম্বর।

ম্যাক্সওয়েলে দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারলে বিজ্ঞানে হয়ত আরও বহু মূল্যবান তথ্য সংযোজিত হতো। তবুও যা তিনি দান করেন গেছেন তার পরিমাণও বড় কম নয়।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *