২২.ইমাম আবু হানিফা (রঃ)
(৭০২-৭৭০খ্রিঃ)
অধঃপতনের যুগে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে যে সকল মনীষীগণ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, পার্থিব লোভ-লালসা ও ক্ষমতার মোহ যাদেরকে ন্যায় ও সত্যের আদর্শ থেকে বিন্দু মাত্র পদলখন ঘটাতে পারেনি, যারা অন্যায় ও অসত্যের নিকট কোন মাথা নত করেননি, ইসলাম ও মানুষের কল্যাণে সারাটা জীবন যারা পরিশ্রম করে গিয়েছেন, সত্যকে আঁকড়ে থাকার কারণে যারা জালেম সরকার কর্তৃক অত্যাচারিত, নিপীড়িত,নির্যাতিত; এমনকি কারাগারে নির্মমভাবে প্রহারিত হয়েছেন, ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তাদের অন্যতম।
ইমাম আবু হানিফা (র:) ঊমাইয়া খলিফাগণে্র দুঃশাসন, কুশাসন ও স্বৈরাচারী কার্যকলাপে সমগ্র মুসলিম
জাহান আতঙ্কিথ হয়ে পড়েছিল। তাদের দ্বারা এমন সব জঘন্য কাজ সম্পাদিত হয়েছিল যা বিশ্ব ইতিহাসে
বিরল। তাদের নিষ্ঠুর কার্যকলাপ কেবল মাত্র নাগরিক ধন-সম্পদ ও জীবনের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়নি
নারী জাতির মান-সম্মান ও সতীত্বও ধূলায় ধুসরিত হয়ে গিয়েছিল। মহানবীর আদর্শ ও খোলাফায়ে রাশেদীনের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে শুধু মাত্র ভুলুস্থি্ত করা হয়নি; চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রঃ) এর নামে রীতিমত জুমআ’র নামাজে প্রকাশ্য মিশরে দাঁড়িয়ে অভিশাপ বর্ষণ করা হত।
খিলাফতের স্থান দখল করেছিল রাজতন্ত্র। অত্যাচারের মূর্ত প্রতীক, যুগের অভিশাপ ও কলক্ক ইয়াবিদ ইবেন যিয়াদ ও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নিষ্ঠুর তরবারির আঘাতে সামান্য কথার জন্যে হাজার হাজার মুসলমানের
মস্থক দেহ হতে বিছিন্ন করা হয়েছিল। লৌহ দন্ডের প্রতাপে ঊমাইয়া বংশীয় খলিফাগণ এমন সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল যেখানে কোন প্রতিবাদ তো দুরের কথা কোন প্রকার সংশোধনের কথা মুখে উচ্চারণ করাই
ছিল নিজের মরণ ডেকে আনা।তরবারির ভয় দেখিযে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেদ করার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
এক কথায় উমাইয়া বংশীয় শাসকগণ ও তাদের বর্রর গভর্নরগণ মুসলিম জাহানে নিষ্ঠুরতার এমন এ নজির স্থাপন করেছিল যা পৃথিবীর ইতিহাসে আজও বিরল। ঠিক এমনি এক যুগসন্ধিক্ষণে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইসলামের বিবেকী কণ্ঠ ও অন্যায়ের প্রতিবাদী ইমাম আবু হানিফা (রঃ ) । উল্লেখ্য যে উমাইয়া বংশীয় খলিফাগণের মধ্যে কেবল মাত্র ওয়ালিদ এবং খলিফা ওমর বিন আবদুল আজীজ (র: ) এর শাসনকালই ছিল ইসলাম ও বাক্তি স্বাধীনতার স্বর্ণযুগ ।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ ) ৮০ হিজরী মোতাবেক ৭০২ খ্রিটাব্দে কূফা নগরীতের জন্মগ্রহন করেন । তাঁর আসল নাম হল নু’মান। পিতার নাম ছাবিত এবং পিতামহের নাম জওতা। তাঁর বাল্যকালের ডাক নাম ছিল আবু হানিফা।
ত্তিনি ইমাম আজম নামেও সর্বাধিক পরিচিত । তাঁর পূর্ব পুরুষগণ ইরানের অদিবাসী ছিলেন । পিতামহ জওতা জম্নভূমি পরিত্যাগ করে তৎকালীন আরবের সমৃদ্ধশালী নগর কূফায় এসে বাসস্তান নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ ) বাল্যকালে লেখাপড়ার কোন সুযোগ পাননি । কারণ তখন কূফায় এসে মাওয়ানী খিলাখতের যুগ । আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান ছিলেন খিলাফতের প্রধান এবং যুগের অভিশাপ, নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ছিলেন ইরাকের শাসনকর্তা ।দেশের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলা প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ ) ১৪/১৫ বছর বয়সে একদিন যখন বাজারে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে তৎকালীন বিখ্যাত ইমাম হযরত শা’বী (রঃ ) তাঁকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, হে বালক, তুমি কি কোথাও লেখাপড়া শিখতে যাচ্ছ? উত্তরে তিনি অতি দুঃখিত স্বরে বললেন, “ আমি কোথাও লেখাপড়া শিখি না।“
ইমাম শা’বী (রঃ ) বললেন, “আমি যেন তোমার মধ্যে প্রতিভার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি্ । ভাল আলমের নিকট তোমার লেখাপড়া শিখা উচিত।”
ইমাম শা’বী (রঃ ) এর উপদেশ ও অনুপ্রেয়ণায় ইমাম আবু হানিফা (রঃ ), ইমাম হামাদ (রঃ ), ইমাম আতা ইবনে রবিয়া (রঃ ) ও ইমাম জাফর সাদিক (রঃ ) এর মত তৎকালীন বিখ্যাত আলেমগণের নিকট শিক্ষা লাভ করেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কুরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইলমে কালাম, আদব প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন । জ্ঞান লাভের জন্য তিনি মক্কা, মদিনা, বসরা , এবং কূফার বিভিন্ন এলাকায় অবস্হানরত আলেমদের নিকট পাগলের ন্যায় ছুটে গিয়েছিলেন । বিভিন্ন ন্থান হতে হাদিসের অমৃল্য রত্ন সংগ্রহ করে স্বীয় জ্ঞান ভান্ডার পূর্ণ করেন । উলে্খ্য যে , তিনি প্রায় চার সহস্রাধিক আলেমের নিকট শিক্ষা লাভ করেছিলেন ।
ইমাম মালেক (রঃ ) এর নিকটও তিনি হাদিস শিক্ষা লাভ করেন । ইমাম মালেক (রঃ ) যদিও বয়সের দিক থেকে তাঁর চেয়ে ১৩ বছরের ছোট ছিলেন; তথাপি ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তাঁকে অশেষ সম্মান করতেন এবং ইমাম মালেক (রঃ) ও ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে শিক্ষকের ন্যায় সম্মান দেখাতেন । আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের আদব কায়দা এমনই হয়ে থাকে।
শিহ্মকগণের প্রতি ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর এত ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল যে, তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন,”আমার শিহ্মক ইমাম হামাদ (রঃ) যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন আমি তাঁর বাড়ির দিকে পা মেলে বসিনি। তাঁর কারণ, আমার ভয় হতো শিহ্মকের প্রতি আমার বেয়াদবি হয়ে যায় কিনা । কারো কারো মতে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তাবেয়ী ছিলেন । সাহাবাগণের যুগ তখন প্রায় শেষ হলেও কয়েকজন সাহাবী জীবিত ছিলেন ।
১০২ হিজরীতে তিনি যখন মদীনায় গমন করেন তখন মদীনায় দু’জন সাহাবী হযরত সোলাইমান (রঃ) ও হযরত সালেম ইবনে সুলাইমান (রঃ) জীবিত ছিলেন এবং ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তাঁদের দর্শন লাভ করেন। কিন্তু অনেকের মতে তিনি সাহাবীর দর্শন পাননি। তবে তাবে’তাবেয়ী হবার ব্যাপারে কোন মতবিরোধ নেই।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর শিহ্মকগণ প্রায় সবাই ছিলেন তাবেয়ী। ফলে হাদিস সংগ্রহের ব্যাপারে তাঁদের মাত্র একটি মধ্যস্ততা অবলম্বন করতে হত। তাই তাঁর সংগৃহীত হাদিস সমৃহ সম্পূর্ণ ছহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে ।
তাফসীর ও হাদিস শাস্ত্রে তার অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও পান্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও ফিকাহ শাস্ত্রে্ই তিনি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি কোরআন ,হাদিস , ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে বিবিধ বিষয়ে ইসলামী আইনগুলাকে ব্যাপক ও পুঙ্খানপুঙ্খ ভাবে আলোচনা করেছেন । বর্তমান বিশ্বের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মুসলমান হানাফী মাজহাবের অনুসারী ।
ফিকাহ শাস্ত্রে তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদানের জন্যই মুসলিম জাতি সত্যের সন্ধান অনায়াসে লাভ করতে পেরেছে ।ফিকাহ শাস্ত্রের উন্নতির জন্যে তিনি ৪০ সদস্য বিশিষ্ট একটি সমিতি গঠন করেন ।
ইমাম আবু হানিফা (র:) ছিলেন সমিতির প্রধান । সমিতির সদস্যদের মধ্যে ইমাম জাফর সাদিক, হাব্বান, ইমাম মুহাম্মদ,উসসুফ, ইয়াদ ইয়া ইবনে আবি জায়েদা,হাব্বান, ইমাম মুহাম্মদ, ইউসুফ ইবনে খালেদ এর নাম উল্লেখযোগ্য ।
ইসলামের বিভিন্ন আইন নিয়ে সমিতিতে স্বাধীন ভাবে আলচনা হত। প্রত্যেকই কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে নিজ নিজ মতামত ব্যক্ত করতেন । অত:পর সর্বসম্মতি ক্রমে সঠিক সিদ্ধান্ত গৃহিত হত এবং তা লিপিবদ্ধ করা হত ।
সুদীর্ঘ ৩০ বছর কাল ইমাম আবু হানিফা (র:)ও অন্যান্যদের আপ্রাণ চেষ্টা ও সাধনার ফলে ফিকাহ শাস্ত্রের উন্নতি সাধিত হয়। তিনি তাঁর শিক্ষাকতা জীবনে পৃথিবীতে হাজার হাজার মূফাচ্ছির, মূহাদ্দিস ও ফকীহ তৈরি করে গিয়েছেন। তাঁর ছাএদের মধ্যে যারা ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে ইমাম মুহাম্মদ(রঃ), ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ ) ও ইমাম যুফার (রঃ ) অন্যতম।
ইমাম আবু হানিফার (রঃ)চরিত্র ছিল বহু গুনে গুণান্বিত। তিনি ছিলেন আত্তসংযমী, মহান চরিত্রবান, পরহেজগার, উদার, দানশীল, অতিশয় বিচক্ষন এবং মূত্তাকিন। তিনি ছিলেন, হিংসা, লোভ, রাগ পরনিন্দা ইত্যাদি থেকে পবিত্র। বিনা প্রয়োজনে কোন কথা বলতেন না।
তিনি সুদীর্ঘ চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত এশার নামাজের ওযু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করতেন। এতে এটাই বুঝা যায় যে, তিনি সারা রাত আল্লাহর ইবাদত ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার মগ্ন থাকতেন।
তিনি কাপড়ের ব্যবসা করে নিজের এবং পরিবারের জীবিকা উপার্জন করতেন। কতিপয় কর্মচারী দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ব্যবসায় যাতে হারাম অর্থ উপার্জিত না হয় সে জন্যে তিনি কর্মচারী সব সময় সতর্ক করতেন।
একবার তিনি দোকানে কর্মচারীদের কিছু কাপড়ের দোষ ত্রুটি দেখিয়ে বললেন, “ক্রেতার নিকট যখন এগুলা বিক্রি করবে তখন কাপড়ের এ দোষগুলা দেখিয়ে দিবে এবং এর মূল্য কম রাখবে।“
কিন্ত পরবর্তী কর্মচারীগণ ভুল ক্রমে ক্রেতা কাপড়ের দোষত্রুটি না দেখিয়েই বিক্রি করে দেন। এ কথা তিনি শুনতে পেরে খুব ব্যাথিত হয়ে কর্মচারীদের তিরস্কার করেন এবং বিক্রিত কাপড়ের সমুদয় অর্থ সদকা করে দেন। তাঁর সততার এ রকম শত শত ঘটনা রয়েছে।
তিনি কখনো সরকারি কোন অনুদান গ্রহন করেননি। নিজের ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতার উর্ধে স্থান দিতেন তিনি।
উমাইয়া বংশীয় খলিফাদের অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক কার্যকলাপ বিরুদ্ধে আস্তে আস্তে সারা দেশে তীব্র আন্দলোন ছিল তুংগে। এ আন্দলোন সগ্রহ ইরাক ও কূফায় উমাইয়া বংশীয় খলিফা মারওয়ানের সিংহাসন কাঁপিয়ে তুলেছিল।
১২৯ হিজরী মারওয়ানের তাঁর বিচক্ষন আমলা ইয়াজিদ ইবনে ওমর হুরায়রাজে কূফার গভর্নর নিযুক্ত করেন। ইয়াজিদ ইবনে হুরায়রা শাসন কাজে ধর্মীয় নেতাদের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। তাই তিনি ক্ষমতা ও অর্থের লোভ দেখিয়ে ধর্মীয় নেতাদের শাসন কার্যে জড়িত করার চেষ্টা চালান এবং ইতিমধ্যে কয়েকজনকে বড় বড় রাজক্রিয় পদত্ত দান করেন। তখন সমগ্র ইরাক ও কূফায় ইমাম আবু হানিফা (রঃ ) এর সুনাম, সততা, জনপ্রিয়তা ছিল সর্বা্ঘায়তই
ইয়াজিদ ইবনে হুরায়রা ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে প্রধান বিচারপতি (কাজী) পদ গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানান।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বুঝতে পেরেছিলেন যত,এটা হল উমাইয়া খিলাফতকে দীর্ঘায়িত করার একটি গভীর ষড়যন্ত। তিনি এটাও বঝতে পেরেছিলেন যে, প্রাদেশিক জালিম গভর্নরদের অধীনে কাজীর পদ গ্রহণ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্টা করা সম্ভব নয়। বিচার কাজে উমাইয়া শাসকদের প্রভাব ফেলতে পারে।তাঁদের অধীনে কাজীর পদ গ্রহণ করার অর্থ হবে সত্য ও ন্যায়কে জলাঞ্জলী দিয়ে ক্ষমতা ও অর্থের মোহে উমাইয়া জালিম শাসক গোষ্টীর গোলামী করা। আগেই বলা হয়েছে যে, তিনি সরকারী কোন সাহায্য গ্রহণ করতেন না এবং অবৈধ ক্ষমতা ও অর্থের লোভ-লালসা তাঁকে কোনদিন স্পর্শ করতে পারেনি। তাই সত্যকে প্রকাশ করতে তিনি কাউকে কখনো ভয় করতেন না।
ইয়াজিদ ইবনে হুরায়রার আমন্ত্রণ পেয়ে শুধুমাত্র প্রত্যাখানই করলেন না বরং সুস্পষ্ট ভাষায় বলেদিলেন।‘প্রধান বিচারপতি পদ গ্রহণ করাতো দূরের কথা,মোটা অংকের বেতন দিয়ে ইয়াজিদ যদি মসজিদের জানালাগুলা গুনবার মত হালকা দায়িত্ব নেয়, তথাপি এ জালেম সরকারের অধীনে আমি তা গ্রহণ করব না।
এতে ইয়াজিদ ক্ষিপ্ত হয়ে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দি করেন। এরপর কারাগারে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদগ্রহণ করার জন্যে অনুরোধ জানান। কিন্তু এতেও তিনি রাজি না হওয়ায় কারাগারে প্রতিদিন তাঁকে বেত্রাঘাত করা হত।
কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রঃ)নির্যাতনের ভয়ে জালিম সরকারের নিকট মাথা নত করেননি। অবশেষে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি মক্কায় চলে আসেন।
১৩১ হিজরীতে উমাইয়া শাসনের অবসান ঘটলে আব্বাসের খিলাফতের সূচনা হয়। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) মক্কা থেকে কূফায় ফিরে আসেন।আব্বাসীয়গণ ইতিপূর্বে আহলে বাইয়াতদের পক্ষে আন্দলোন করলেও, ক্ষমতা লাভের পর আহলে বাইয়াতদের প্রতি খড়গহস্ত হয়ে উঠেন এবং ধর্মীয় নেতাদের প্রতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক নির্যাতন চালাতে শুরু করেন।
আব্বাসীয় বংশীয় তাঁদের প্রতিবন্দি উমাইয়া বংশীয়দের প্রায় সম্পূর্ণ রুপে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এমন কি উমাইয়া খলিফাদের কবর খুঁড়ে তাঁদের অস্থি পাঁজর তুলে এনে জ্বালিয়ে ফেলেছিল।আব্বাসীয় বংশীয় খলিফা মনসূর সিংহাসনে বসে আহলে বাইয়াত ও আলেম সমাজের প্রতি অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চালান।
১৪৫ হিজরীতে মুহাম্মদ নাফসে জাকিয়া খলিফা মনসূরের অনৈসলামিক ও অমানবিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং যুদ্ধে শহীদ হন। ইমাম মালেক (রঃ) ও ইমাম আবু হালিফা (রঃ) সহ প্রায় সকল ধর্মীয় নেতাগন মুহাম্মদ নাফসে জাকিয়ার পক্ষে ছিলেন।নাফসে জাকিয়া শহীদ হবার পর তাঁর ভ্রাতা ইব্রাহীম বিদ্রোহের পতাকা স্বহস্তে তুলে নেন এবং তৎকালীন দীনদার মুসলমান আলেম সমাজ ইব্রাহীমের পতাকাতলে সমবেত হতে লাগলেন। জানা যায়, একমাত্র কূফা নগরেই বিশ লক্ষ মুসলমান মনসুরের বিরুদ্ধে মুহম্মদ ইব্রাহীমের পক্ষে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত গ্রহণ করেছিল।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ)মুহাম্মদ ইব্রাহীমকে গোপনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্যে প্রচুর অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। যুগের নিষ্ঠুর ও জালেম মনসূর গোপনে বহু উপকন পাঠিয়ে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে হাত করতে চেষ্ঠা করলেন। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এগুলাকে প্রত্যাখান করেছেন। অবশেষে ১৪৬ হিজরীতে খলিফা মনুসূর ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে বাগদাদে খলিফার দরবারে তলব করেন। তিনি খলিফার দরবারে উপস্থিত হলে তাঁকে প্রাধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করার অনুরোধ জানান। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রঃ) জালেম সরকারের অধীনে এ পদ গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। তিনি বুঝতে পেয়েছিলেন যে একটা মনসুর গভীর ষড়যন্ত।
এছাড়া এ পদ গ্রহণ করার অর্থ হবে ন্যায়, ইনসাফ ও ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে জালেমের পূজারী করা। তাই ইমাম আবু হানিফা (রঃ) খলিফা মনসূরকে বললেন, “ আমি প্রধান বিচারপ্তির পদ গ্রহণ করার যোগ্য নই’।
এতে খলিফা রাগান্বিত স্বরে বললেন, আপনি মিথ্যাবাদী প্রত্যুত্তরে ইমাম সাহেব বললেন, “আপনার কথা যদি সত্যি হয় (অর্থাৎ আপনার কথানুযায়ী আমি যদি মিথ্যাবাদী হই) তাহলে আমার কথাই সঠিক। কারণ একজন মিথ্যাবাদি রাষ্ঠ্রের “প্রধান বিচারপতি” পদের যোগ্য নয়।
অতঃপর খলিফা মনসুর কোন উত্তর দিতে না পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দী করার নির্দেশ দেন। কারাগারে বসেও ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ফিকাহ শাত্রের তাঁর কঠোর সাধনা চালিয়েছিলেন। কারাগারে বসেই তিনি বিভিন্ন কঠিন মাসআলার জবাব দিতেন।বিভিন্ন জায়গা থেকে শত শত মানুষ এসে কারাগারেই মাসআলা শিক্ষা লাভ করে যেতেন। ইমাম আবু ইউসূফ (রঃ) লিখেছেন, ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কেবল মাত্র কারাগারে বসেই ১২ লক্ষ ৯০ হাজার অধিক মাসআলা লিপিবন্ধ করেছিলেন।
এরপর খলিফা মনসুর একদিন খাদ্যের সাথে বিষ মিশিয়ে দেন ।ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বিষ ক্রিয়া বুঝতে পেরে সিজদায় পড়ে যান এবং সিজদা অবস্থায়ই তিনি ১৫০ হিজরীতে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।
ইমাম আবু হানিফা(রঃ) এর মৃত্যুর সংবাদ বিদ্যুতের গতিতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের সর্বস্ততরের লোকজন মৃত্যুর সংবাদ শুনে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। কথিত আছে, তাঁর জানাজায় পঞ্চাশ হাজারের অধিক লোক অংশ গ্রহণ করেছিল; কিন্তু লোকজন আসতে থাকায় ৬ বার তাঁর জানাজা পড়া হয়েছিল। তাঁর অছিয়ত অনুযায়ী বিজরান গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।