৩৪. ইবনে খালদুন

Ibn-Khaldun

৩৪. ইবনে খালদুন
(১৩২২-১৪০৬ খ্রীঃ)

মানব জাতির কল্যাণে আল্লাহ রাব্বুর আ’লামীন যুগে যুগে এ ধরাতে পাঠিয়েছেন অসংখ্য নবী-রাসূল ও মনীষীদেরকে । যে ক’জন মুসলিম মনীষী মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা, শিল্প, সাহিত্য,  ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে তাঁদের অমূল্য অবদানের জন্যে আজও সমগ্র বিশ্বে অমর হয়ে আছেন, ব্যক্তি স্বর্থের জন্যে যারা কখনো অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথা নত করেন নি, যারা জ্ঞান সাধনার উদ্দেশ্য দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন,

ভোগ বিলাসকে উপেক্ষা করে যারা সারাটা জীবন কাটিয়েছেন মানুষের কল্যাণে, যারা জালেম শাসকদের স্বৈরশাসনকে সমর্থন না দিয়ে কারাগারে কাটিয়েছেন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, তাঁদের মধ্যে ইবনে খালদুন অন্যতম ।

১৩২২ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে মে আফ্রিকার তিউনিসিয়ায় এক সমভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । ইবনে খালদুনের পুরো নাম আবু জায়েদ ওয়ালী উদ্দিন ইবনে খালদুন । তাঁর পিতার নাম মুহাম্মদ ইবনে খালদুন । ‘খালদুন’ হচ্ছে বংশের উপাধি । তাঁর পূর্ব পুরুষগণ ইয়েমেন থেকে এসে তিউনিসে বসতি স্থাপন করেন । তাঁর পিতামহ তিউনিসের সুলতানের মন্ত্রী ছিলেন । পিতা ছিলেন খুব জ্ঞান পিপাসু। বাল্যকাল থেকেই ইবনে খালদুন জ্ঞান সাধনায় মশগুল হন । তাঁর মেধা ও স্মরণশক্তি ছিল বিস্ময়কর । মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআনের তাফসীর শিক্ষা শেষ করেন । দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান সাধনার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ । যে কোন বিষয়ে কোন বই পেলেই তা তিনি পড়ে শেষ করে ফেলতেন । ফলে অল্প বয়সেই তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞঅন লাভ করেন ।

জ্ঞান সাধনায় মত্ত এ মনীষীর জীবনের এ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নেমে আসে এক ভয়ানক দুর্যোগ । ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিউনিসে দেখা দেয় ‘প্লেগ’ নামক মহামারী । এ মহামারীতে তাঁর পিতামাতা, শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজন ও অনেক বন্ধুবান্ধব মারা যান । এ সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ১৭/১৮ বছর । পিতামাতাকে হারিয়ে তিনি শোকে-দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়েন এবং সংসারে নেমে আসে অভাব অনটন । জীবিকা নির্বাহের তাগিদে ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন তিউনিসের সুলতান আবু মুহাম্মদ এর ব্যক্তিগত সহকারী হিসাবে তিনি চাকুরিতে যোগদান করেন । যেহেতু সংসারে মা বোন কেউ ছিল না, তাই ২২ বছর বয়সে ১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিবাহ করতে বাধ্য হন । জ্ঞান পিপাসু এ মনীষী বিবাহের পর আমোদ প্রমোদ ও ভোগ বিলাসে ডুবে যাননি বরং গভীর আগ্রহে জ্ঞান চর্চা শুরু করেন । আস্তে আস্তে সারা দেশে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে ক্রমান্বয়ে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন । চলে আসেন আন্দালুসিয়ায় । সেখানে গ্রানাডার সুলতানের অনুরোধে তিনি কেস্টিল রাজ্যে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন । কিছুদিন দায়িত্ব পালন করার পর ১৩৬৬ খ্রিস্টাব্দে আবার চলে আসেন স্বদেশভূমি কিউনিসে এবং এখানে তৎকালীন সুলতান আবু আবদুল্লাহর অনুরোধে ‘বগী’ নামক রাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে চাকুরিতে যোগদান করেন ।

পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় যে, প্রায় প্রত্যেক মনীষীই নিজ মাতৃভূমিতে মর্যাদা পাননি বরং নির্যাতিত, বিতাড়িত এবং ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন । ইবনে খালদুন ও তাঁদের থেকে আলাদা নন । তিউনিসিয়ার ‘বগী’ রাজ্যে তিনি বেশি দিন অবস্থান করতে পারেননি । সেখানে তিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হন । সুলতান আবু আবদুল্লাহকে তাঁর দুই ভাই আবুল আব্বাস হত্যা করে রাজ্য ছিনিয়ে নেন এবং ইবনে খালদুনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করেন । তিনি কোন উপায় বগী রাজ্য ত্যাগ করে চলে যান । তেলেমচীন রাজ্যে যা মরক্কোর একটি ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল । মরক্কোর সুলতান আবদুল আজীজ ইবনে আল হাসান এ ক্ষুদ্র রাজ্যটি দখল করে নিলে তিনি সুলতানের হাতে বন্দী হন । সুলতান ইবনে খালদুনের জ্ঞান প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মুক্তি দানের আদেশ দেন । তখন প্রায় অধিকাংশ দেশে রাজনৈতিক অসিথরতা ও যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত । আন্দলুসিয়ার সুলতান কর্তৃক মরক্কো দখল হলে ইবনে খালদুন পুনরায় গ্রেফতার হন এবং আনুমানিক ১৩৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুক্তি লাভ করেন ।

মুক্তি পেয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ে তিনি চলে আসেন আন্দলুসিয়ায় এবং জ্ঞান সাধনা ও ইতিহাস রচনায় মনোনিবেশ করেন । কিন্তু এখানেও তিনি শান্ত ও নিরাপত্তা পেলেন না । জালেম, নিষ্ঠুর ও ক্ষমতা লিপ্সু শাসকদের ষড়যন্ত্রের কারণে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে, পোহাতে হয়েছে অনেক দুর্ভোগ । এ সময় আন্দালুসিয়ার সুলতান ছিলেন আল আহমার । তিনি ইবনে খালদুন কে খুব সম্মান দিয়েছিলেন । কিন্তু এ সময় মরক্কোর নতুন আমীর ইবনে খালদুনকে গ্রেফতার করার জন্যে লোক পাঠালে ইবনে খালদুন আন্দালুসিয়া ত্যাগ করে চলে যান উত্তর আফ্রিকায় । সে সময় উত্তর আফ্রিকায় ইবনে খালদুনের খুব প্রভাব ও সুখ্যাতি ছিল ।

তিনি ছিলেন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব; যিনি দুঃখ কষ্টকে বরণ করে নিয়েছেন । কিন্তু সত্য ও ন্যায়কে প্রকাশ করতে কাউকে ভয় করতেন না । তখন তেলেমচীনের আমীর আবু হামুর এর মন্ত্রী ছিলেন তাঁর ভাই ইয়াহিয়া । তিনি এখানে সর্ব সাধারণ বিশেষ করে গরীব ও সমাজের নির্যাতীত ও নিপীড়িত মানুষের সাথে মেলামেশা করতে লাগলেন । ক্রমে ক্রমে ইবনে খালদুনের মানব সেবা, প্রতিভা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে জনগণ তাঁর ভক্ত হতে লাগল এবং তাঁর নিকট তাদের বিভিন্ন অভাব অভিযোগের কথা প্রকাশ করতে শুরু করল । আমীর আবু হামু ভাবলেন, জনগণ যেভাবে তাঁর দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে তাতে দেশে যে কোন সময় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে । তাই আমীর আবু হামু ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ইবনে খালদুনের বিরুদ্ধে প্রজা বিদ্রোহের অভিযোগ উত্থাপন করেন । এতে ইবনে খালদুন তেলেমচীন ত্যাগ করে বানু আরিফ প্রদেশে চলে যান এবং শান্তিতে বসবাস শুরু করেন । এখানেই তিনি আমীর মুহাম্মদ ইবনে আরিফের দেয়া নিরাপত্তা ও সহযোগিতায় বিশ্ববিখ্যাত কিতাব ‘আল মোকাদ্দিমা’ রচনা করেন । এ কিতাবের মাধ্যমে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ বিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক ও দার্শনিক হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেন । ‘আল মুকাদ্দিমা’ তিনি যে মৌলিক চিন্তা ধারায় পরিচয় দিয়েছেন তা পৃথিবীতে আজও বিরল । তিনি সুস্পষ্ট ভাষাই বলেছেন যে, ঐতিহাসিক বিবরণ ও ঘটনাপঞ্জী লিপিবদ্ধ করাই ঐতিহাসকের কাজ নয় বরং জাতির উত্থান পতনের কারণগুলোকেও বিশ্লেষণ করতে হবে । তিনি ‘আল মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে জাতিসমূহের উত্থান পতনের কারণগুলো সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ।

১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মাতৃভূমি তিউনিসে পুনরায় ফিরে আসেন কিন্তু মাতৃভূমির জনগণ তাঁকে সম্মন দেয়নি । অবশেষে ১৩৮২ খ্রিস্টাব্দে চলে যান মিসরে । সেখানে তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে মিসরের সুলতান তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদে নিযুক্ত করেন । মিসরের কায়রোতে তিনি প্রায় ২৪ বছর কাটিয়েছিলেন । এখানেই তিনি ‘আত তারিক’ নামক আত্মচরিত্র গ্রন্থ রচনা করেন ।

তিনি সমাজ বিজ্ঞান ও বিবর্তনবাদ সম্পর্কে অনেক নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করেন । বিবর্তনবাদের নতুন তথ্য ইবনে খালদুনই সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করেছিলেন । ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর লেখা ‘কিতাব আল ইবর’ বিশ্বের প্রথম এবং সর্ববৃহৎ ইতিহাস গ্রন্থ । ইবনে খালদুনের বিভিন্ন রচনাবলী ইউরোপে বিভিন্ন অনূদিত হবার পর সমগ্র বিশ্বে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে । উল্লেখ্য যে, এমন এক সময় ছিল যখন মুসলিম জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিল । পরবর্তীতে ইউরোপের লোকের মুসলিম মনীষীদের জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্যকে চর্চা করে ক্রমান্বয়ে আজ উন্নতির শিখরে উঠেছে । কিন্তু মুসলিম জাতি তাদের পূর্ব পুরুষদের সুবিশাল জ্ঞঅন ভান্ডারকে উপেক্ষা করায় আজ বিশ্বের বুকে অশিক্ষা, দরিদ্র ও পরমুখাপেক্ষী জাতি হিসেবে পরিণত হয়েছে ।

১৪০০ খ্রিস্টাব্দে দিগ্বিজয়ী বাদশা তৈমুর সিরিয়া আক্রমণ করেন এবং মিসর অভিযানের প্রস্তুতি নেন । ঠিক এ সময় ইবনে খালদুন মিসরের সুলতানের অনুরোধে একটি শান্তি চুক্তির প্রস্তাব নিয়ে বাদশা তৈমুরের দরবারে উপস্থিত । দীর্ঘ আলোচনার পর বাদশা তৈমুর ইবনে খালদুনের জ্ঞান, বুদ্ধি ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর শাস্তি প্রস্তাব মেনে নেন । তৈমুর তাঁর মিসর অভিযান স্থগিত ঘোষণা করেন । এভাবে ইবনে খালদুন তাঁর জ্ঞান ও প্রতিভা দিয়ে একটি অনিবার্য সংঘাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করলেন । বাদশা তৈমুরের বিশেষ অনুরোধে ইবনে খালদুন দামেস্কে কিছুদিন অবস্থান করেন । এরপর ফিরে আসেন মিসরে । মিসরেই এ বিখ্যাত মনীষী ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন । এ মনীষী মুসলিম জাতির জন্যে যে জ্ঞান রেখে গেছেন তা ইতিহাস চিরকাল অমর হয়ে থাকবে ।

“ একজন বিদ্যাহীনের বিনয়ী স্বভাব, অহঙ্কারী বিদ্যানের চাইতেও প্রশংসনীয় ।”
………. ইবনে খালদুন

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *