৭৪. হো চি মিন
[১৮৯০-১৯৬৯]
সকলে তাকে ডাকে ‘আঙ্কেল’ বলে। রোগা পাতলা চেহারা, মুখে সামান্য দাড়ি। পরনে সাদাসিদেপোশাক। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই কি অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর তেজ লুকিয়ে আছে নুষটির মধ্যে। সমস্ত বিশ্বের কাছে তিনি বিপ্লবের প্রতীক, আলোকের দূত,মা
ভিয়েৎনামের প্রাণপুরুষ হো চি মিন। কোন কোন মানুষ জীবনে সংগ্রাম করেন। আবার কারোর গোটা জীবনটাই সংগ্রাম। হো চি মিন ছিলেন চিরসংগ্রামী সৈনিক।
১৮ বছর বয়সে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য শুরু হয় তাঁর সংগ্রাম। ৭৯ বছর বয়সে যখন তাঁর জীবন শেষ হল তার প্রাক মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করে গিয়েছেন আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। যেদিন সেই সংগ্রাম শেষ হল জয়ী হল তাঁর স্বদেশভূমি, সে দিন তিনি তা প্রত্যক্ষ করবার জন্য পৃথিবীতে না থাকলেও, পৃথিবীর মানুষের অন্তরে ধ্রবতারার মত চিরজীবী হয়ে রইলেন। ১৮৯০ সালের ১৯শে মে উওর ভিয়েৎনামের নখেআন প্রদেশের এক গ্রামে হো চি মিনের জন্ম। তাঁর পিতৃদত্ত নাম নগুয়েন থান খাট। বাবার নাম নগুয়েন মিন হুয়ে। তাঁরা ছিলেন তিন ভাইবোন। হো ছিলেন সকলের চেয়ে বড়। বাবা ছলেন এক দরিদ্র চাষী। যখন চাষের কাজ থাকত না,অন্যের জমিতে খেতমজুরি করতেন। ছেলেবেলা থেকেই দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শিশু বয়স থেকেই হো ছিলেন গ্রামের সমবয়সীদের চেয়ে আলাদা। শান্ত ধীর অন্যেরা যখন খেলা করত, তিনি বাবাকে কাজে সাহায্য করতেন। সারাদিন নানান কাজকর্মে কেটে যেত। রাতের বেলায় মায়ের কাছে শুয়ে গল্প শুনতেন। ছেলেবেলা থেকেই হো – কে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত বীর মানুষদের গল্পগাথা। হোয়ের শৈশবে মায়ের সান্নিধ্য ছিল সবচেয়ে প্রিয়। সেই সান্নিধ্য বেশিদিন ভোগ করতে পারলেন না হো। হো তখন এগারো বছরের বালক। ছেলের বিমর্ষতা দেখে গ্রামের পাঠশালায় তাঁকে ভর্তি করে দিলেন নগগুয়েন। অল্পদিনেই পড়াশুনায় আগ্রহ জন্মে গেল হোয়ের। পাঠশালার প্রাথমিক পাঠ শেষ করলেন।
হো ছিলেন পাঠশালার সেরা ছাত্র। ছেলের এই আগ্রহ দেখে নগুয়েন স্থির করলেন, তাঁকে বড় স্কুলে ভর্তি করে দেবেন।
গ্রামে বড় স্কুল ছিল না। হো ভর্তি হলেন হুয়ে শহরের হাই স্কুলে। এই প্রথম গ্রামের বাইরে এলেন হো। এ তাঁর চেনাজানা পরিবেশ নয়, অন্য জগৎ। এতদিন ছিলেন স্বাধীন। শহরে এসে হো প্রথম উপলব্ধি করলেন তাঁরা পরাধিন। তাদের দেশ শাসন করছে বিদেশী ফরাসীরা। নিজেদের মাতৃভূমিতেও নিজেদের কোন অধিকার নেই।
১৯৫৬ সালের ৮ই মে জেনেভায় বসল আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন। পশ্চিমি দেশগুলি শান্তির শর্ত হিসাবে ভয়েৎনামকে বিভক্ত করতে চাইল। যুদ্ধক্লান্ত ক্ষতবিক্ষত ভিয়েৎনামের মানুষের কথা চিন্তা করে এই প্রস্তাব মেনে নিলেন হো। যদিও তিনি অন্তর থেকে চেয়েছিলেন ভিয়েৎনাম এক ও অবিভক্ত থাকুক। উত্তরের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন নো দিন জিয়েস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি তাঁকে এই আসনে বসিয়েছিলেন পুতুল সরকার হিসাবে দেশ শাসন করবার জন্য। স্থির হয়েছিলেন সেই বছরই দেশের দুই অংশে নির্বাচন হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছিল এই নির্বাচন হলে হো হবেন সমগ্র ভিয়েৎনামের রাষ্ট্রপ্রধান। তাই আমেরিকার প্ররোচনায় নির্বাচন করা সম্ভব হল না। হো ছিলেন অত্যাচারী শাসক। অল্পদিনেই তাঁর শোষণ অত্যাচারে সমস্ত দক্ষিণের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। দাবি উঠল অখন্ড ভিয়েৎনামের । তাদের সাহায্য এবার এগিয়ে এল উত্তরের মানুষ। হো সমর্থন জানালেন দক্ষিণের মানুষের গণ আন্দোলনকে।হো সে দিন সরকার বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে এবার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আমরিকা। শুরু হল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক নারকীয় অত্যাচার। একদিকে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দেশ আমরিকা, অন্যদিকে এক ক্ষুদ্র সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ ভিয়েৎনাম।
সেই অজেয় শক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সামান্যতম বিচলিত হয়নি ভিয়েৎনামের সামান্যতম বিচলিত হয়নি ভিয়েৎনামের সাধারণ মানুষ কারণ তাহাদের সাথে ছিলেন তাদের প্রিয় নেতা হো চি মিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েৎনামের বুকে যে পরিমাণ নাপাম বোমা ফেলেছিল ইাতহাসে বিরল। ভিয়েৎনামের মানুষ হোর নেতৃত্ব সেদিন প্রমাণ করছিল কোন অস্ত্র দিয়েই মানুষের অদম্য মনোবলকে ধ্বংস করা যায় না। হো দেশের মানুষকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন, তোমরা ইস্পাতের মত কঠিন, বজ্রের মত মহাতেজী হও।
১৯৬৯ সালের ১০ই মে অসুস্থ হয়ে পড়লেন হো। বুঝতে পারলেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন। তিনি জনগণের উদেশ্যে তাঁর শেষ বার্তা রচনা করলেন। ‘যখন আমার জীবনের শেষ ক্ষণ আসবে তখন আমার সমস্ত মন ভরাক্রান্ত হবে আরো দীর্ঘদিন তোমাদের সেবা করতে পারলাম না বলে। আমার মৃত্যুর পর কোন শোক অনুষ্ঠান করে যেন জনগণের অর্থ আর সময়ের অর্থ আর সময়ের অপচয় না করা হয় সবশেষে আমি রেখে গেলাম পার্টির সকল সদস্য, সেনাবাহিনী আর প্রতিটি স্বদেশবাসীর জন্য আমার গভীর ভালবাসা।’
এর পরেই তাঁর মৃত্যু হয়।
তাঁর মৃত্যুতে ভিয়েৎনামের মানুষের সংগ্রাম শেষ হয়নি। তাঁর স্বদেশপ্রেম আর আত্মিক শক্তির অনুপ্রেরণা তেই উজ্জীবিত হয়ে একদিন তারা আমেরিকাকে বিতড়ন করে নতুন স্বাধীনতা পতাকাকে উড্ডীন করছিলেন।
হো চি মিন আর নেই। কিন্তু তাঁর অস্তিত্ত্ব শুধু ভিয়েৎনাম নয়, পৃথিবীর সমস্ত সংগ্রামী মানুষের মধ্যে আজও চির বিরাজমান।