৯৩. হেনরিক ইবসেন

HENRY

৯৩. হেনরিক ইবসেন

  [১৮২৮-১৯০৬]

শেক্সপিয়ারের পর ইউরোপের নাট্যজগতে সবচেয়ে প্রভাব যিনি বিস্তার করেছিলেন, তাঁর নাম হেনরিক ইবসেন।
নরওয়ের স্কিন শহরে তাঁর জন্ম (২০ মার্চ ১৮২৮)। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। পারিবারিক সূত্রে তাঁদের তাদের মধ্যে ডাচ জার্মান স্কট জাতির সংমিশ্রণ ঘটেছিল। যখন ইবসেন নিতান্তই বালক সেই সময় তাঁর বাবা ব্যবসায়ে সর্বস্বান্ত হন। সুখের সংসারে নেমে আসে চরম দারিদ্র্য। নিদারুণ আর্থিক অনটনের মধ্যেই শুরু হল হেনরিক ইবসেনের শৈশব। ছেলেবেলা থেকেই সমাজের নির্মম বাস্তবতাকে জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি।

তাঁর স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবার, নিদারুণ অভাবের জন্য প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডীটুকুও শেষ করতে পারলেন না। এই সময় তাঁরা স্কিন শহর ত্যাগ করে এলেন ডেনস্টপে। ষোল বছর বয়সে এক ঔষধের কারখানায় কাজ পেলেন। এখানকার পরিবেশ ছিল এক কিশোরের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। তবুও তারই মধ্যে ছটি বছর তিনি এখানে অতিবাহিত করেন। এখানকার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে তাঁর মানসিকতাকে গড়ে তুলতে খুবই সাহায্য করেছিল। এখানে কাজ করবার সময়েই তিনি দেখেছিলেন সমাজের অভিজাত শ্রেণীর কদর্য রূপ। দরিদ্র মানুষদের প্রতি তাদের কি নিদারুণ অবজ্ঞা আর ঘৃণা, এই ঘটনা থেকেই তাঁর মনের মধ্যে জেগে উঠতে থাকে সমাজের প্রতি তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণা, এবং মাঝে মাঝেই তাঁর আচরণের মধ্যে এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটত।

যখন তিনি ঔষধ কারখানাতে কাজ করতেন তখনই প্রথম তিনি সাহিত্যের দিকে আকৃষ্ট হন। কাজের অবসরে যখনই সময় পেতেন নানান বিষয়ের বই নিয়ে পড়তেন, সাহিত্যচর্চা করতেন। প্রথম কবিতা রচিত হয় যখন তাঁর ১৯ বছর বয়সে। স্থানীয় পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতা রচনার সাথে সাথে রাজনীতির প্রতিও আকৃষ্ট হয়ে ওঠেন। পরবর্তী দুবছরের মধ্যে তাঁর বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিত হল। কবি হিসাবে জনগণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

ইতিমধ্যে কিছু অর্থ সঞ্চয় করে ঔষধ কারখানার চাকরি ছেড়ে দিলেন। আসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পড়াশুনা আরম্ভ করলেন। ২২ বছরে তিনি ভর্তি হলেন আসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক সংকীর্ণ পরিবেশ থেকে এলেন এক উন্মুক্ত জগতে। এখানে তিনি পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। গ্রীক নাট্যকারদের নাটক পড়ে তাঁর মনের মধ্যে ধীরে ধীরে নাটক লেখার রচনা করেন Cataline. বন্ধুবান্ধবদের সহযোগিতায় তা প্রকাশিত হল। এর অল্পদিনের মধ্যেই রচনা করলেন The Viking’s Tomb নাটকটি মঞ্চস্থ হল কিন্তু তা কয়েকদিনের বেশি চলল না।

সাহিত্য সাধনায় এত বেশি মনোযোগি হয়ে ওঠেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেন। বাধ্য হয়ে একটি পত্রিকায় কয়েক মাসের জন্য সাংবাদিকের চাকরি নিলেন। নাটকের প্রতি তাঁর ছিল স্বভাবসিদ্ধ আকর্ষণ। সাংবাদিক হিসাবে কাজ করবার সময়েই নাট্যজগতের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৮৫১ সালে ওল বুল নামে একজন বিখ্যাত বেহালাবাদক বার্গেন শহরে একটি রঙ্গমঞ্চ স্থাপন করলেন। তিনি ইনসেনকে এখানে মঞ্চসজ্জা ও কবিতা রচনার জন্য নিযুক্ত করলেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর ইবনেস বার্গেন রঙ্গমঞ্চের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই সময় শুধু যে তাঁর রচিত কয়েকটি নাটক এখানে মঞ্চস্থ করতে পেরেছিলেন তাই নয়, ইউরোপের বিভিন্ন নাট্যকারদের নাটকের সাথেও পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাছাড়া নাটক দর্শক রঙ্গমঞ্চ সম্বন্ধেও বিস্তৃত ধারণা হয়। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে তাঁকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছিল।

এক বছর পর ১৮৫২ সালে ইবেসেনকে দেশ-বিদেশের নাট্যকলার সাথে পরিচিত হবার জন্য বার্গের থিয়েটারের তরফ থেকে একটি বৃত্তি মঞ্জুর করা হল। ইবসেন প্রথম গেলেন ডেনমার্কে তার পর জার্মানী। জার্মানীতে থাকার সময় তিনি লিখলেন মিড সামার ইভ (Mid Summer Eve) নামে একটি নাটক। পরের বছর এই নাটকটি মঞ্চস্থ হল। এই সময় আরো কয়েকটি নাটক লিখেছিলেন। এই সব নাটকগুলির মধ্যে তাঁর ধারাবাহিক উন্নতির চিহ্ন লক্ষ্য করা গেলেও প্রতিভার কোন পরিচয় প্রকাশ পায়নি। তাছাড়া কোন নাটকই মঞ্চে সফল হয়নি।

বার্গেনের রঙ্গমঞ্চটি দর্শকের অভার বন্ধ হয়ে গেল। অন্য সকলের মত ইবসেনকেও চাকরি হারাতে হল। সংসারে তখন আর ইবসেন একা নন, সাথে সদ্য বিবাহিতা পত্নী সুসালা থোরসেন। সুসালার বাবা ছিলেন নরওয়ের একজন প্রেম পরিণয়। সুসালা সমস্ত জীবন ছিলেন ইবসেনের যোগ্য সঙ্গিনী। চাকরি হারিয়ে নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়লেন ইবসেন। অভার আর দারিদ্র্য দীর্ঘ দিন পর্যন্ত ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। এক বছর পর ক্রিস্টিয়ানিয়া নরওয়েজিয়ান থিয়েটারের ম্যানেজারের চাকরি পেলেন।

পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস পর্যন্ত তিনি প্রায় ৮টি নাটক লিখেছিলেন। এই নাটকগুলির মধ্যে বিছিন্নভাবে কিছু শিল্পকর্ম থাকলেও কোন মৌলিকত্ব বা পরিণত শিল্পসৃষ্টির প্রকাশ ছিল না। এর মধ্যে একটি নাটক Lover’s Comedy কিছু নাট্যমোদীর ভাল লাগলেও তার থেকে অর্থ উপার্জন করতে পারেননি।

ইবসেন জীবনের প্রথম পর্যায়ে ছিলেন রোমান্টিক, তারপর হলেন বাস্তববাদী। ১৮৮৪ সালে নাটকের দেখা গেল পরিবর্তন, এই সময়ে লেখা নাটকগুলি প্রধানত প্রতীকধর্মী-The Wild Duck(1889), The lady from the sea (1888), এই নাটকগুলির মধ্যে লক্ষ্য করা যায় সমসাময়িক জীবনের সমস্যা থেকে সরে গিয়ে সচেষ্ট হয়েছেন মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে। তাঁর Hedda Gables একটি অসাধারণ নাটক। নোরার পরে হেড্ডা সবচেয়ে বিখ্যাত নারী চরিত্র। তাকে সমালোচকরা লেডি ম্যাকবেথের সাথে তুলনা করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে হেড্ডা ঘৃণিত, দুশ্চরিত্র এক নারী। তবুও লেখক সেই পঙ্কের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন পদ্মকে। হেড্ডার সৌন্দর্য বোধ, তার সাহস লেখককে মুগ্ধ করেছে- তার মধ্যেকার সব হীনতা, কর্মদর্যতা, প্রতারণার অন্তরালে জীবনের সব বাধাকে অতিক্রম করে মুক্তি পাওয়ার যে তীব্র কামনা, যে দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা, তার মধ্যে দেখা যায়- তার কোন তুলনা হয় না। এখানেই তাঁর মহত্ত্বতা। তবে এই সব নাটকগুলিতে তাঁর ব্যক্তিগত শিল্প চিন্তা বিশ্লেষণ এত প্রাধান্য পেয়েছে যে নাটকগুলির গতিস্বতন্ত্রতা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাহত হয়েছে। এরপরে লেখেন The Master Builder (1892), When we dead awaken (1899)। ইউরোপে যে নারী জাগরেণের ঢেউ ‍উঠেছিল, তারই জয়ধ্বনি শোনা যায় শেষের নাটকটিতে। ইবসেন তাঁর জীবিতকালেই ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসাবে সম্মান পেয়েছেন। ১৮৮০ থেকে ১৯২০-এই দীর্ঘ চল্লিশ বছর ইউরোপের রঙ্গমঞ্চে ইবসেনের প্রাধান্য ছিল সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তাঁর নাটক। ইউরোপে প্রথম তাঁর নাটকের সার্থক মূল্যায়ন করেছিলেন বার্নার্ডশ।

তিনি শুধু যে নাটকের মধ্যে দিয়ে সামাজিক আন্দোলন স্থাপন করেছেন তাই নয়, তিনি নাটকের আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও নিয়ে এসেছেন নতুন যুগ। চিরাচরিত রীতিকে বর্জন করে নাটকের গঠনশৈলীকে সহজ-সরল করেছেন। নাটকে তিনি রোমান্টিকতা বর্জন করে ন্যাচারলিজম বা বাস্তবদের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। বিংশ শতাব্দীর নাট্যকারদের উপর তাঁর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। জীবিতকালে প্রচুর পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু পুরস্কারের কোন মোহ ছিল না ইবসেনের। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাঁর লেখালেখি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯০০ সালে অসুস্থ হয়ে পড়লেন, বিশেষ হাঁটা-চলা করতে পারতেন না। ধীরে ধীরে তাঁর স্মৃতিভ্রংশ হতে  থাকে। ১৯০৩ সালে একেবারেই পঙ্গু হয়ে যান। ১৯০৬ সালের ২৩শে মে বেলা আড়াইটের সময় তাঁর জীবন দীপশিখা চিরদিনের মত নিভে গেল।

তাঁর উদ্দেশ্য শ্রদ্ধা জানিয়ে সমালোচক এম. ব্লক বলেছিলেন, Modern Drama begins with Ibsen-যথার্থই তিনি আধুনিক নাটকের জনক।

 

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *