৬৫. ফ্রান্সিস বেকন

৬৫. ফ্রান্সিস বেকন

[খ্রিঃ১৫৬১-খ্রিঃ ১৬২৬]

ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সমূহ একরকম দার্শনিক চিন্তাধারায় মধ্যে আবদ্ধ ছিল। অথচ তারই পাশাপাশি চলছিল কারিগরদের দ্বারা নতুন যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন।কারিগররা অবশ্য বিশেষ কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ধারপাশে যেতেন না।কেবল প্রয়োজনই তাদের উদ্বুদ্ধ করাতো নব নব আবিষ্কারে। বিজ্ঞান ও কারিগরী বিদ্যার মধ্যে দূরত্ব ছিল অনেকখানি।পন্ডিতেরা চিন্ত্য করে দেখলেন,এই দুটির মধ্যে বিভেদ আদৌ নেই।

বরং একটি অপরটির পরিপূরক । তখন তারা বিজ্ঞান ও কারিগরীবিদ্যার মধ্যে সমন্বয় সাধনে যত্নবান হন।অপরদিকে তাঁদের দেখাদেখি কারিগররাও যন্ত্রপাতি নিমার্ণের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে প্রয়োগ করতে প্রায়সী হন। ফলে দার্শনিক তত্ত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে বিজ্ঞান তার আপন পথটি খুঁজে পায়।এক কথায় তখনই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আসে একটি বিপ্লব। এই বিপ্লবকে যাঁরা বহন করে এনেছিলেন তাঁদের ফ্রান্সিস বেকন নিঃসন্দেহে একজন।

বেকন ১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম জীবনের দর্শন ও আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন করার পর তিনি তিনি অধ্যাপক হিসাবে জীবন শুরু করেন। অতি অল্পদিনের মধ্যে তাঁর পান্ডিত্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায়  ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস্ এর বিচার বিভাগে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ আসতেন, বেকন অধ্যাপনা বৃত্তি পরিত্যাগ করে বিচার বিভাগে যোগদান করেন এবং অনন্যাসাধারণ প্রতিভার জন্য অতি অল্পকালের মধ্যে ‍তিনি উক্ত বিভাগের প্রধানরূপে মনোনীত হন।

বেকন ছিলেন মূলত দার্শনিক তবে বিজ্ঞানের প্রতি ছিল তাঁর আনাতরিক টান।এতবড় দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেই ভাবনা চিন্তা আরম্ভ করেন। এই উদ্দেশ্য তিনি সংগ্রহ করেন প্রাচীন গ্রীক পন্ডিতদের আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমূহ প্রচলিত বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলী।তার ফলেই বিজ্ঞানের নতুন সম্ভাবনার কথা তাঁর মনে উদিত হয়।

বেকন অতঃপর কারিগরীবিদ্যা এবং প্রচলিত যন্ত্রপাতির দিকে আর্কষণ বোধ করেন। কিছুকাল এ বিষয়ে চিন্তা করার পর তার জন্মে, ঐ বিজ্ঞান এবং কারিগরীবিদ্যাই মানবসভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসে মূখ্য ভূমিকা গ্রহণ করবে।উৎসাহিত বেকন এবার আরম্ভ করেন প্রচন্ড পরিশ্রম করা।তাঁর চিন্তা ভাবনাগুলি ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করেন “দি অ্যাডভনসমেন্ট অফ লার্নিং” নামক একখানি পুস্তকের আরে।প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান ও কারিগরী বিদ্যাকে জনপ্রিয় করার এই তাঁর প্রথম প্রয়াস এবং সত্য কথা বলতে কি, এই ধরনের প্রায়স তাঁর পূর্বে কেউ করেন নি।’

১৬২০ খ্রিষ্টাব্দে বেকন প্রকাশ করেন “গ্রেট ইনষ্টরেশন অফ লার্নিং” নামক দ্বিতীয় একখানি মহামূল্য পুস্তক। বিজ্ঞানের  ইতিহাস এ্ই পুস্তককানির গুরুত্ব অনেকখানি।পুস্তকটির প্রথম খন্ডে বেকন প্রচলিত বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলি সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেন এবং নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন।এই খন্ডে তিনি উল্লেখ করেন যে,বিজ্ঞানকে অগ্রগতির দান করতে হলে নতুন নতুন তত্ত্ব ও পদ্ধতির উদ্ভাবন করতে হবে এবং প্রাচীন বৈজ্ঞানিক মতবাদগুলি সংগ্রহ করতে হবে। পন্ডিত ব্যক্তিরা যাতে এই কাজে এগিয়ে আসেন তার জন্যও তিনি অনুরোধ রাখেন।পুস্তকখানির দ্বিতীয় খন্ডে তিনি যন্ত্রবিদ্যার উল্লেখ করেন এবং কোন কোন যন্ত্রে কোন কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রযুক্ত হয়েছে তাও ব্যাখা করেন।তৃতীয় খন্ডে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যম প্রাচীন বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলিকে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ঠ হন।চতুর্থ খন্ডে কারিগরি জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্ক আলোচনা করেন।পুস্তকখানির আরও কয়েকটি খন্ড তিনি প্রকাশ করেন চেয়েছিলেন কিন্তু সময়াভাবে কৃতকার্য হতে পারেন নি। ফ্রান্সিস বেকনের চিন্তাধারা তৎকালীন পশ্চিমসমাজে যথেষ্ট আলোড়নের সৃষ্টি করে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথ উন্মুক্ত হয়।প্রকৃতপক্ষে  বিজ্ঞানরাজ্যে তিনিই প্রথম বিপ্লবের সূচনা করেন। পরে গ্যালিলিও,দেকার্ত প্রভৃতি মহামনীষীদের আপ্রাণ চেষ্টা ও যত্নে বিজ্ঞান তার নিজের পথের সন্ধান লাভ করে।তাই ফ্রান্সিস বেকনের নাম বিজ্ঞান চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করবে।

১৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে এই মহান চিন্তানায়কের জীবনাবসান হয়।

 

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *