৬৭. চেঙ্গিস খাঁন

৬৭. চেঙ্গিস খাঁন
(১১৬২-১২২৭)

ইতিহাসে বিতর্কিত পুরুষ কম নেই। তাদের নিয়ে আলোচনাও কম হয়নি।কিন্ত এমন কোনও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব নেই চেঙ্গিস খানের মতন যার সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ ঠিক সেইখানটিতেই থেমে আছে যেখানটাতে শুরু হয়েছিল। তার কারণ অবশ্য কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করে যে চেঙ্গিস খান একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। সমাজ সংগঠনের জন্য যার অবদান অসীম এবং এখনও উল্লেখ্যযোগ্য ।

কিন্তু সেই তারই পাশাপাশি অনেকেরই স্থিরবিশ্বাস যে চেঙ্গিস খানের মতন অত্যাচারী সেনানায়ক ইতিহাস বিরল এবং তিনি শুধু ঘৃণারই যোগ্য।

মোঙ্গোল জাতির প্রতিষ্ঠাতা চেঙ্গিস খান এখন থেকে সাত শতাব্দী আগের তার দিগ্বিজয় শুরু করেছিলেন। এই দিগ্বিজয়ের ইতিহাস অনেকের কাছে বিশেষ করে মোঙ্গোলদের কাছে লজ্জার ইতিহাস হয়ে আছে।

১১৬২ খ্রিষ্টাব্দে চেঙ্গিস খানের জন্ম মোঙ্গোলিয়ার উত্তরপূর্ব এলাকার দূর প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। দীর্ঘদেহী এবং অত্যন্ত বিশাল ছিল তার শরীর । ঐতিহাসিক নাজজোনি লিখেছেন যে চেঙ্গিস খানের চোখ ছিল কটা,বিড়ালের মতন অত্যন্ত সর্তক ছিল তার দৃষ্টি। মোঙ্গোলিয়ান ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষাতে তার দখল ছিল না । তিনি লিখতে শেখেন নি । ঐতিহাসিক বার্থহোলডের ভাষায় চেঙ্গিস খান আক্ষরিক অর্থেই নিরক্ষর ছিলেন,কিন্তু সামজিক প্রয়োজনের এবং সামরিক প্রয়োজনের প্রতি তার দৃষ্টি ছিল প্রখর-ডাকপিওনের ব্যবস্থা তিনি তার রাজ্যে জুড়ে প্রবর্তন করতে পেরেছিলেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে চেঙ্গিস খান একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা এবং সেনানায়ক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। ইতিহাসের ধারাও অবশ্য তিনি পরিবর্তন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মেঙ্গোলিয়ার স্তেপ অঞ্চলের মধ্যাঞ্চল চেঙ্গিস খান তার রাজদানী স্থাপন করেছিলেন। তার রাজদানীর নাম ছিল কারাকোরাম। কারাকোমারে শ্বেত প্রাসাদে রত্নখচিত সিংহাসনে বসে তিনি দূর চীন,ইউরোপ,পারস্য এবং ভারতবর্ষের রাষ্ট্রদূতদের সাদর সম্ভাষণ জানাতেন।  সেখানে বসেই তিনি পরিকল্পনা করতেন পরবর্তী যুদ্ধের। সেই সব যুদ্ধের পরিগতিতে মোঙ্গোল বাহিনী পৌছে গিয়েছিল ভিয়েনার দ্বারপ্রাস্ত পর্যন্ত । এই কারাকোরাম শহর পরবর্তী সময়ে ধুলিসাৎ করে দেওয়া হয়েছিল তার প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহায়। সেই ধ্বংসস্তুপ আর কোনদিন নতুন করে সৃষ্টি করা হয়নি।

মোঙ্গোলিয়ান রাষ্ট্রের বর্তমান রাজধানী উলান বাটোরে চেঙ্গিস খানের একটি প্রতিকৃতি ছাড়া আর কিছুই দৃশ্যমান নেই।

 বলা বাহুল্য স্তেপ অঞ্চলের অসংখ্য ছোট দল উপদলের সমন্বয় সাধন করে বিশাল একটি রাজত্ব স্থাপনের কৃতিত্ব চেঙ্গিস খানের ছিল । মোঙ্গোল অঞ্চলকে একটি সৃনির্দিষ্ট জাতিতে পরিণত করার পর চেঙ্গিস খান অতঃপর তার সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাপিঁয়ে পড়লেন দিগ্বিজয়ে। ধীরে ধীরে মধ্য এশিয়া থেকে তার রাজত্ব বিস্তৃত হল পারস্য পর্যন্ত। পারস্য অধিকার করার পর তিনি জয় করলেন রাশিয়া,পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলি। অন্যদিকে চীন এবং ভিয়েতনাম পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত হতে দেরী হল না।১২২৭ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ৬৫ বছর বয়সে মারা যাওয়ার সময়ে পর্যন্ত তিনি নিজেকে  “ মানবজাতির সম্রাট” আখ্যায় ভূষিত করেছিলেন। সম্ভবত পৃথিবীতে অন্য কোনও সম্রাট এরকম একটি পদবিচিহ্নে করার ধৃষ্টতা দেখায় নি।

মোঙ্গোলিয়াতে জনসাধারণের মধ্যে সেই ঘৃণা,সেই ধৃষ্টতা,সেই অহংকারের পরিবর্তে রয়েছে শান্তভাব। অতিথিবৎসল হওয়া উৎসাহ। মোঙ্গোলিয়ার একটি পাঠ্যপুস্তকে চেঙ্গিস খান সম্পর্কে লেখা রয়েছে- “ অসংখ্য দল উপদলকে একত্রিত করে চেঙ্গিস খান যে একটি রাষ্ট্র তৈরি করেছিলেন সেই কৃতিত্ব অবশ্যই স্বীকার করতে হয়। কিন্তু তার সেই যুদ্ধের মনোভাব ধ্বংসের মনোভাব সমর্থন করা যায় না।”

অবশ্য সাম্প্রতিককালে চেঙ্গিস খানের প্রতি যুবক মোঙ্গোলদের মনোভাব একটু বদলেছে সম্ভবত। তারা চেঙ্গিস খানকে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের সঙ্গে তুলনা করতে চাইছে,জুলিয়াস সিজারের সঙ্গে তুলনা করতে চাইছে। পৃথিবীর ইতিহাসের চেঙ্গিস খানের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গর্ব বোধ করতে চাইছে। উলান বাটোরের একজন অধ্যাপক লিখছেন যে তার ছাত্রছাত্রীরা ’ সিক্রেট হিটলার” পাঠ করার পর চেঙ্গিস খানকে নিয়ে মনে মনে খুবই গর্ববোধ করে থাকে। মানুষ হিসেবে,নেতা হিসেবে তাকে বিশাল পুরুষ হিসাবেই ভাবতে চায়। যদিও সকালে স্বীকার করেন যে চেঙ্গিস খানের সাম্রাজ্যবিস্তারের পদ্ধতিটি সমর্থযোগ্য নয়। রাশিয়ার অধিকার করার পর সেখানে চেঙ্গিস খান এবং তার বংশধরদের রাজত্ব চলেছিল ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে অবধি।

সেসময় অত্যাচারও কম হয় নি। রাশিয়ার জনগণের মনে তার প্রতিক্রিয়া খুবই স্পর্শকাতর হয়ে আছে।চীন চেঙ্গিস খানের প্রশাংসাব্যজ্ঞক বিজ্ঞপ্তি ছেপে ব্যাপারটা আরও গুলিয়ে দিয়েছে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *