৩২. ভাস্করাচার্য

vaskoracharjo

৩২. ভাস্করাচার্য
[১১১৪ -১১৮৫]

প্রায় ৮৫০ বছর  আগেকার কথা। দক্ষিণ ভারতের বিজ্জবিড় নামে এক নগরে বসে করতেন এক ব্রাক্ষণ নাম ভাস্করাচার্য ।অঙ্ক এবং জ্যোতিষ দুটি বিষয়েই ছিল তাঁর অসাধারণ পান্ডিত্য।নগরের সীমানা ছাড়িয়ে পড়েছিল দূর দেশে।

দেশের রাজা মহারাজা থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করত। এত সম্মান খ্যাতি তবুও মনে সুখ ছিল না। ভাস্করাচার্যের একমাত্র সন্তান লীলাবতী রুপে সরস্বতী গুনে লক্ষী,শাস্ত ধীর, অসাধারণ মেধাবী । মুখে মুখে পিতার কাছ থেকে শাস্ত্রের নানান পাঠ নিয়েছে।

এমন গুনবতী,রুপবতী কন্যা তবুও ভাস্করাচার্য নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় কষ্ট পান।জন্ম  সময়ে তিনি কন্যার ভাগ্য গনণা করে কোষ্ঠী প্রস্তুত করেছেন। তাতে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে কন্যার বৈধব্যযোগ। এ কথা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। এতদিন ভুলেই ছিলেন। কিন্তু এখন যে কন্যা বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশীরা মেয়ের বিবাহের কথা বলেছে। অনেকেই লীলাবতীকে বিবাহ করতে  চায়।দিবারাত্র ভাবতে থাকেন ভাস্করাচার্য। কার সাথে তাঁর কন্যার বিবাহ দেবেন? জেনেশুনে একটি ছেলের জীবন নষ্ট করবেন।

এক সময় তাঁর মনে হল গনণায় কোন ভুল হয়নি তো? আরো কয়েকজন গণৎকারকে দিয়ে নতুন করে গনণা করালেন। সকলেই একমত, এই কন্যার বিবাহ দেওয়া উচিত নয়। বিবাহের অল্পদিনের মধ্যেই এর স্বামীর মৃত্যু হবে। কিন্তু এর কি কোন প্রতিকার নেই? ভাবতে থাকেন ভাস্করাচার্য। সমস্ত পুঁথিপত্র নিয়ে বসলেন। কয়েক দিন ধরে অবিশ্রাস্ত গনণা করার পর একটি মাত্র শুভক্ষণ পেলেন। ঐ শুভক্ষণ বিবাহ হলেই একমাত্র কন্যার বৈধব্যযোগ রোধ করা সম্ভব। কন্যার । উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পেতে দেরি হল না। বিবাহের প্রস্তুতি আরম্ভ হল।

বিবাহের শুভদিন এসে গেল।সকাল থেকে ভাস্করাচার্য উদ্বিগ্ন, সেই শুভক্ষণ যেন পার না হয়ে যায়। সময় নির্ধারণ করবার জন্য বালু ঘড়ি বষানো হয়েছে কক্ষের একদিকে। বারংবার ভাস্করাচার্য নিজে এসে সময় দেখছেন।

সেই যুগে সময় নির্ধারণ জন্য বালু ঘড়ি ব্যবহার করা হত। বালু ঘড়িতে দুটি কাঁচের পাত্র উপর-নিচ করে বসান হত। দুটি পাত্রে একটি করে ছোট ফুটো ছিল।একটি পাত্রে বালি ভর্তি থাকত। তার থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে বালি ঝরে পড়ত। নির্দিষ্ট সময়ে পাত্রটি খালি হলে তা আবার উল্টো করে দেওয়া হত। আর তাঁর থেকে সময় নির্ধারণ করা হত। লীলাবতী প্রকৃত ব্যাপারটি জানত না। বারংবার কৌতুহলী হয়ে বালু ঘড়ির দিকে গিয়ে দেখছিল।এদিকে পুরোহিত অপেক্ষা করে থাকেন। সময় পার হয়ে যায় । লগ্ন যে আর হয় না। অর্ধেক হয়ে বালু ঘড়ির উপর ঝুঁকে পড়ে সময় দেখছিল তখন অজান্তে গলার হার থেকে একটি মুক্তো খসে পড়ে বালির ছিদ্রটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই কখন যে বিষয়ে লগ্ন পার হয়ে গিয়েছিল কেউ জানতে পারেনি।

দুঃখে ভেঙ্গে পড়লেন ভাস্করাচার্য। কন্যার বিবাহ হল। বিধির বিধান খন্ডন করে মানুষের সাধ্য কি! অল্পদিনের মধ্যেই স্বামিকে হারিয়ে পিতার কাছে ফিরে এলেন লীলাবতী।কন্যার জীবনের সব আনন্দ সুখ চিরদিনের জন্য মুছে গেল । তাঁর জীবনের দুঃখ ভোলবার জন্য ভাস্করাচার্য কন্যাকে বিদ্যাশিক্ষা দিতে আরম্ভ করলেন। আর সেই জন্য রচনা করলেন গণিত শাস্ত্রের বিশাল এক গ্রন্থ সিদ্ধান্ত শিরোমণি-এই গ্রন্থের মোট চারটি খন্ড। প্রথমে খন্ডের নাম লীলাবতী-এতে সাধারণ গণিত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লীলাবতী পৃথিবীর আদিমতম গণিতের গ্রন্থ। প্রাচীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা।

আনুমানিক ১১১৪ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের বিজ্জবিড় গ্রামে ভাস্করাচার্যে জন্ম হয়।তাঁর জীবন কাহিনী সম্বন্ধে যতটুকু জানা যায় তার কতটুকু সত্য কতটুকু কল্পনা তা বিচার করা কঠিন।তবে সাম্প্রতিক কালে বোম্বাই এর অন্তর্গত চালিসগাও নামে একটি স্থান থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি পুরানো মন্দিরের শিলালিপি থেকে জানা যায় ভাস্করাচার্যে পিতার নাম ছিল মহেশ দৈবন্ত,তাঁর পিতার নাম মনোরথ, তার উর্ধ্ধতন পুরুষদের নাম যথাক্রমে প্রভাকর,গোবিন্দ,ভাস্করভট্ট এবং ত্রিবিক্রম।ভাস্করাচার্যের দুই পুত্রের নাম জানা যায়-লল্ক্ষীধর এবং চঙ্গদেব।এরা সকলেই ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ। পান্ডিত্যের জন্য তারা ছিলেন সকলের শ্রদ্ধেয়।শিলালিপিতে প্রত্যেকের সম্বন্ধেই রয়েছে প্রশস্তি। তবে ভাস্করাচার্যের প্রশংসায় মুখরিত হয়ে উঠেছে লিপিকার। তাঁকে বলা হয়েছে ভট্ট পারদর্শী তিনি সাংখ্য, তন্ত্র,রেদে মহাপন্ডিত। তাঁর তুল্য জ্ঞান আর কারো নেই।কায্যে, কবিতায়,ছন্দে, অতুলণীয়।গণিতে শিবের মতই তিনি মহাজ্ঞানী, তার চরণে প্রণাম জানাই।

এই লিপিতে কোথাও লীলাবতীর উল্লেখ নেই। তাহলে লীলাবতীর অস্তিত্ব কি শুধুই কাল্পনিক। এই বিষয়ে নানা রকম মত আছে।অনেকের ধারণা লীলাবতী ছিলেন ভাস্করাচার্যের কন্যা। তিনি অন্যন্ত বিদূষী ছিলেন। লীলাবতী অংশটি তারই রচিত।ভাস্করাচার্য সমগ্র সিদ্ধান্ত শিরোমণি গ্রন্থটি কন্যাকে উৎসর্গ করেছিলেন।কেউ বলেল লীলাবতী নামে কোন নারীরই অস্তিত্ব নেই।কারণ এই বইটির বিভিন্ন শ্লোকে কোথাও সখে,কোথাও প্রিয়ে, চঞ্চলা ইত্যাদি সম্বোধন করেছেন। কন্যাকে কেউ প্রিয়ে বা সখে বলে সম্বোধন করে না। সম্ভবত ভাস্করাচার্য জ্ঞানের দেবী সরস্বতকেই বিভিন্ন সম্বোধনে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করেছেন।

লীলাবতী প্রসঙ্গে যতই বিতর্ক থাক,মূল পুস্তকখানি নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। এর প্রথম খন্ড লীলাবতীতে সাধারণ গণিত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর প্রথমে রয়েছে পনেশ বন্দনা আর মঙ্গলাচারণ।লীলাবতীতে মোট ২৭৮টি শ্লোক আছে। এতে সরল গণিতের বিভিন্ন পদ্ধতি সহজভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সাধারণ যোগ,ঘনমূল,অনুপাত,সমানুপাত,বিপরীত ক্রিয়া,সুদকথা,ভগ্নাংশ, লাভক্ষতি।

গণিত ছাড়াও লীলাবতীতে জ্যামিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এতে আছে ত্রিভুজ,চতুর্ভুজ ট্রাপিজিয়ম,বৃত্ত। প্রতিটি বিষয়েই তাঁর আলোচনা মোটামুটি নির্ভুল । লীলাবতী থেকে  একটি অংকের উল্লেখ করা হল। একজন ব্যক্তি কিছু অর্থ নিয়ে তীর্থযাত্রা করেছিল। তাঁর মোট সঞ্চিত অর্থের অর্ধেক প্রয়োগ ব্যয় করল।অবশিষ্ট অর্থের দুই নবমাংশ কাশীতে ব্যয় করল। পথখরচ বাবদ তাঁর ব্যয় হল অবশিষ্টের এক চতুর্থাংশ। অবশিষ্টের ছয় দশমাংশ ব্যয় হল গাঁজাতে। তীর্থযাত্রীর হাতে অবশিষ্ট রইল মাত্র ৬৩টি মূদ্রা।ভাস্করাচার্য প্রশ্ন রেখেছেন তীর্থযাত্রীটি কত মুদ্রা নিয়ে পথে বার হয়েছিল।

প্রায় ৯৫০ বছর আগে রচিত অঙ্কটির সমরুপ অঙ্ক বর্তমান কালের স্কুলের ছাত্ররাও করে থাকে সিদ্ধান্ত শিরোমেণির অন্তর্ভুক্ত হলেও লীলাবতী গ্রন্থটি স্বতন্ত্র পুস্তকের মর্যাদা পেয়েছিল। এবং এটি বহুল প্রচলিত ছিল।

দ্বিতীয় খন্ড বীজগণিত। এতে মূলত সমীকরণ ও দ্বিঘাত সমীকরণের তত্ত্বগুলি নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে তবে ভাস্করাচার্য এই তত্ত্বগুলির উদ্ভাবক নন। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীধরাচার্য প্রথম দ্বি সমকিরণ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তাঁর গ্রন্থটির নাম ছিল গণিতাসার।

এতে বীজগণিত পাটিগণিতের বহু নিয়ম আলোচিত হয়েছে। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ভগ্নাংশ, সুদ নির্ণয়, দ্বিঘাত সমীকরণ,বর্গমূল,ঘনমূল প্রভুতি।

ভাস্করাচার্য ছিলেন সাহসী, সংস্কারমুক্ত, উদার মনের মানুষ।মধ্যযুগে ভারতবর্ষের মানুষ ধর্মীয় চিন্তা ভাবনার জগতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল, সেই যুগের বুকের উপর দাড়িয়ে তিনি সমস্ত ভ্রান্ত ধারণাকে ছিন্নভিন্ন করে সত্যেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এর মধ্যে দিয়ে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।শুধু তাই নয়,তিনি যখন অন্যের মতকে খন্ডন করেছেন তখন প্রতিপক্ষের কাছে মার্জনা চেয়ে নিতে দ্বিধা করেননি। ভাস্করাচার্যে মধ্যে ছিল সাহস,সত্যকে প্রকাশ করবার দৃঢ়তা, সেই সাথে উদারতা।

ভাস্করাচার্য প্রায় ৭১ বছর জীবিত ছিলেন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তিনি করুণকুতুল নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থখানি তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে সমৃদ্ধ।

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *