৪৩.বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন
[১৭০৬-১৭৯০]
আমেরিকার ইতিহাসে যদি বহুমুখী ব্যাক্তিত্বের অধিকারী কোন পুরুষের নাম করতে হয় যিনি একাধারে ছিলেন মুদ্রাকর,দাশর্নিক,রাজনীতিবিদ,অথর্নীতিবিদ,রাষ্ট্রের সংবিধানে রচয়িতা,বিজ্ঞানী,আবিষ্কারক,যার সম্বন্ধে দেশবাসী শ্রদ্ধা-অবনত চিত্তে বলেছিল আমাদের হিতৈষী মহাজ্ঞানী পিতা-সেই মানুষটির নাম বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।শুধু আমেরিকার নন সমগ্র মানব জাতির তিনি হিতৈষী বন্ধু।
এই মহাজ্ঞানী কমযোগীর জন্ম আমেরিকার বোষ্টন শহরে।১৭০৬ সালের জানুয়ারী মাসে।তাঁর বাবা ধমীয় কারণে ইংল্যান্ড ত্যাগ করে আমেরিকায় গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন।বেঞ্জামিন জন্মের আগে তাঁর মা চৌদ্দটি সন্তানের জন্ম দেন।তাঁর বাবা অতিকষ্টে এই সংসার প্রতিপালন করতেন।ছেলেবেলায় বেঞ্জামিন কোনদিনই আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখেননি।
যখন তাঁর আট বছর বয়স, বাবা তাঁকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।কয়েক বছর স্কুলের খরচ মেটালেও শেষ পযর্ন্ত আর পারলেন না । বেঞ্জামিনকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে নিজের সাবান তৈরির কারখানায় ঢুকিয়ে দিলেন। কিন্তু েএই কাজে কিছুতেই মন বসল না বেঞ্জামিনের। ব্যবসার প্রতি কোনদিন তাঁর কোন আকষণ ছিল না। তাঁর আগ্রহ ছিল সমুদ্রে ভেসে বেড়াবার।
১৭৭৩ সালে মৃত্যু পযর্ন্ত মিসেস রীড ছিলেন বেঞ্জামিনের সুযোগ্য স্ত্রী।
১৭৩৩ সাল নাগাদ পুত্তর রিচার্ডস আলমানকে নামে একটি ধারাবাহকি প্রকাশ করলেন। এ রচনা অল্পদিনেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল।
ধনী ও খ্যাতিমান ব্যাক্তি হিসাবে বেঞ্জামিন ক্রমশই ফিলডেলফিয়া শহরে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। অথ উর্পাজনরে সাথে সাথে সমাজসংস্কারমূলক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বেঞ্জামিন। ইতিমধ্যে তিনি ফিলাডেলফিয়া শহরে একটি সংস্থা স্থাপন করেছিলেন। ,নাম “ডুটো”। এর উদ্দেশ্য ছিল সমাজের উন্নতিতে পারস্পরিক সহায়তা।
এই সংস্থায় তিনি যেসব প্রবন্ধ পাঠ করতেন সেই অনুসারে নানান সমাজসংস্কার মূলক কাজকম পরিচালনা করতেন। সমাজের প্রতি সমস্যার প্রতি তাঁর ছিল তীক্ষ্ন দৃষ্টি।
তিনি দেখেছিলেন দেশে উপযুক্ত গ্রন্থাগারের অভাব। অধিকাংশ মানুষই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্থের অভাবে বই কিনতে পারে না। সবর্ত্র লাইব্রেরী স্থাপন করাও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। তাই ১৭৩০ সালে তিনি স্থাপন করলেন ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী। আমেরিকায় এই ধরনের লাইব্রেরী এই প্র্রথম । এর জনপ্রিয়তা দেখে অল্পদিনেই আরো অনেক ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী গড়ে ওঠে।
১৭৩৭ সালে তিনি আমেরিকাতে প্রথম স্থাপন করলেন বীমা কোম্পানি। এই কোম্পানির কাজ ছিল আগুনে পুড়ে যাওয়া সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
১৭৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন ফিলাডেলফিয়া একাডেমি। এই একাডেমি তাঁর জীবন কালেই পরিণত হয়েছিল ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বেঞ্জামিনের দৃষ্টিভঙ্গি যে কতখানি ব্যাপ্ত ছিল তাঁর প্রমান পাওয়া যায় হাসপাতাল নির্মাণের কাজে। ডাক্তার না হয়েও তিনি অনুভব করেছিলেন হাসপাতাল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা। তাঁর বন্ধু ডাক্তার বন্ডকে পরামশ দিলেন হাসপাতাল তৈরির কাজে হাত দিতে।
বেঞ্জামিনের আন্তরকি সহযোগিতায়, ডাক্তার বন্ডের প্রচেষ্টায় ১৭৫১ সালে আমেরিকার গড়ে উঠল প্রথম হাসপাতাল।
এইসব বহুমুখী কাজের মাধ্যমে বেঞ্জামিন হয়ে উঠেছিলেন আমেরিকার সবজন শ্রদ্ধেয় মানুষ।
১৭৪০/৪১ সাল নাগাদ তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা কাজকম শুরু করেন। আবিষ্কারক হিসাবে তাঁর প্রথম উদ্ভাবন খোলা উনুন(Open stove)। এই উনুন অল্পদিনেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে বিদ্যুৎ শক্তির প্রতি আগ্রহ ছিল সব চেয়ে বেশি।একদিন আকাশে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে আকাশের বিদ্যুৎচমক দেখে প্রথম অনুভব করলেন আকাশের বিদ্যুৎ আর কিছুই নয়, বিদ্যুৎ এক ধরনের ইলেকট্রিসিটি। ইতিপূর্বে মানুষের ধারণা ছিল আকাশে যে বিদ্যুৎ চমকায় তা দেবরাজ ডিউসের হাতের অস্ত্র। যখন তিনি মানুষকে ধ্বংস করতে চান তখনই তার এই অস্ত্র প্রয়োগ করেন। তাই আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে মানুষ ভীত স্বম্ত্রস্ত হয়ে পড়ত,পূজা-অচর্না করত। ফ্রাঙ্কলিন সেই ভ্রান্ত ধারণাকে চিরদিনের জন্যে মুছে দিলেন। তখন লিডেন জার উদ্ভাবিত হয়েছে। এই যন্ত্রের সাহাস্যে র্দীঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবার পর তিনি প্রমাণ করলেন বৈদ্যুতিক শক্তি দু ধরনের। একটিকে বলে নেগেটিভ, অন্যটিকে বলে পজেটিভ। তাঁর আবিষ্কৃত এই নতুন তত্ত্ব বৈদ্যুতিক গবেষণার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সংযোজন।
আধুনিক কালে আমরা যে টিউব লাইট দেখি তা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ। বৈদ্যুতিক শক্তি সংক্রান্ত এইসব আবিষ্কার এই সব আবিষ্কারের গবেষণাপত্র তিনি প্রথম পেশ করেন লন্ডনের রয়াল সোসাইটিতে। তারপর থেকেই তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সময়ে সমুদ্রেস্রোতে,তার গতি,প্রকৃতি সম্বন্ধে কয়েকটি গবেষণাপত্র রয়াল সোসাইটিতে জমা দেন। এছাড়া তিনিই প্রথম বাইফোকাল লেন্সের ব্যবহার শুরু করেন।তাঁর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং এই সম্পর্কিত বিভিন্ন রচনা অল্পদিনেই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিজ্ঞানী মহলে সাড়া জাগাল। এই সমস্ত দেশের বিজ্ঞানীরা তাকে বিপুলভাবে সম্মান জানাল।ইংল্যান্ডের রয়াল সোসাইটি তাঁকে তাদের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত করল। অক্সর্ফোড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁতে ডক্টর উপাধিতে ভূষিত করল।
ইতিমধ্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পেনসিলভেনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাক্তি। জনগনণর তরফ থেকে তাঁকে সংসদ নির্বাচিত করা হল (১৭৫০) । এই সময় থেকে তিনি ক্রমমই রাজনৈতিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি চেয়েছিলেন আমেরকিা সমৃদ্ধি,শ্রীবৃদ্ধি।
তাঁর এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বিচক্ষণতার জন্য আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যের তরফ থেকে প্রতিনিধি হিসাবে একাধিকবার ইংল্যান্ড,ফ্রান্স,জার্মানি, আয়ারল্যান্ড,স্কটল্যান্ড গিয়েছেন। যেখানেই তিনি গিয়েছেন সেখানেই পেয়েছেন অভূতর্পূব সম্মান আর সম্বধর্না।
এদিকে সমস্ত দেশ জুড়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকার অধিবাসীদের মনে ক্ষোভ জমে উঠতে থাকে। আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিল।১৭৭৫ সালের ১৯শে এপ্রিল আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ হল।
পরের মাসেই ফিলাডেলফিয়া শহরে আমেরিকা কংগ্রেসের অধিবেশন বসল। এখানেই জজ ওয়াশিংটনকে আমেরিকান বাহিনীর প্রধান হিসাবে নির্বাচিত করা হয়। দেশের এই স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভা নিয়ে ঝাপিঁয়ে পড়লেন বেঞ্জামিন। তাকে আমেরিকার প্রতিনিধি হিসাবে পাঠানো হল ফ্রান্সে। তিনি অল্পদিনেই ফ্রান্সের সঙ্গে কূটনৈতিক সর্ম্পক স্থাপন করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহ করলেন।
১৭৮৩ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর তিনি দেশের উন্নয়নের কাজে ঝাপিঁয়ে পড়লেন। তাকে পেনসিলভেনিয়ার শাসন পরিষদের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত করা হল।
নতুন আমেরিকা গড়ে উঠবার পর নতুন শাসনতন্ত্র রচনার প্রয়োজন দেখা দিল। ডাক পড়ল বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের। তিনি আরো কয়েকজনের সহযোগিতায় রচনা করলেন আমেরিকা সংবিধান। এই সংবিধানের মধ্যে দিয়ে তিনি আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করলেন। তখন তার বয়স হয়েছিল একাশি। এই বয়সেও তিনি ছিলেন তরুনদের মতই উদ্যামী কমঠ।
সকল মানুষের প্রতি ছিল তার আন্তরিক ভালবাসা। জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে নিগ্রো দাসদের দুরবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। তাই দাসপ্রথা বিলোপের আন্দোলনে ঝাপিঁয়ে পড়েন। তিনি যে কাজের সূত্রপাত করেন, উত্তরকালে লিঙ্কন তা সমাপ্ত করেন।
১৭৯০ সালে সামান্য রোগভোগের পর তার মৃত্যু হয়।
বিজ্ঞান, দশন, রাজনীতি, অথর্নীতি-সবক্ষেত্রেই অসংখ্য রচনার মধ্যে দিয়ে নিজের অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। সমস্ত জীবন সেই লক্ষ্যপথেই অগ্রসর হয়েছেন- তাই তাঁর সম্বন্ধে এমাসন বলেছেন, তিনি ছিলেন মানবজাতির সবচেয়ে হিতৈষী বন্ধু।