১৬. অশোক
(খ্রিঃ পূঃ ৩০০-২৩২)
প্রতিবেশী দুটি সাম্রাজ্য মগধ এবং কলিঙ্গ । মগধ অপেক্ষাকৃত বড়, তার শক্তিও তুলনায় বেশি । তবুও মগধ সম্রাটের মনে শান্তি নেই । প্রতিবেশী এক শত্রুকে রেখে কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায় ।
দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনীই শক্তিশালী । কিন্তু মগধের সৈন্যরা অনেক বেশি যুদ্ধপটু আর কৌশলী । কলিঙ্গের সৈন্যরা বীর বিক্রমে লড়াই করেও পরাজিত হল । আহত আর নিহত সৈন্যে ভরে উঠল যুদ্ধক্ষেত্র । রক্তাক্ত হল সমস্ত প্রান্তর । কলিঙ্গরাজ নিহত হলেন ।
বিজয়ী মগধ সম্রাট হাতির পিঠে চেপে যেতে যেতে দেখলেন তাঁর দুপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কত অসংখ্য মৃতদেহ । কত আহত সৈনিক । কেউ আর্তনাদ করছে, কেউ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে চিৎকার করছে । কেউ সামান্য একটু পানির জন্য ছটফট করছে। আকাশে মাংসের লোভে শকুনের দল ভিড় করছে ।
যুদ্ধক্ষেত্রের সেই বিভীষিকাময়দৃশ্য দেখে সম্রাট বিষণ্ন হয়ে গেলেন । অনুভব করলেন তাঁর সমস্ত অন্তর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে । ধীরে ধীরে নিজের তাবুতে ফিরে শিবিরের সামনে দিয়ে চলেছে এক তরুণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ।
সন্ন্যাসী বললেন, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের সেবা করতে চলেছি ।
মূহূর্তে অনুতাপের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল সম্রাটের হৃদয় । সম্রাটের অন্তরে জ্বলে উঠল,নতুন এক প্রজ্ঞার আলোক । তিনি শপথ করলেন আর যুদ্ধ নয়, আর হিংসা নয়, ভগবান বুদ্ধের করুণায় আলোয় অহিংসা মন্ত্রে ভরিয়ে দিতে হবে সমগ্র পৃথিবী ।
একদিন যিনি ছিলেন উন্মক্ত দানব- এবার হলেন শাস্তি আর অহিংসার পূজারী প্রিয়দর্শী অশোক । খ্রিস্টপূর্ব ২৭২ সালে বিন্দুসারের মৃত্যুর পর পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের অধিকার নিয়ে বিবাদ শুরু হচ্ছিল । বিন্দুসারের জেষ্ঠ্য পুত্রের নাম সুষীন,দ্বিতীয় পুত্র অশোক । সুষীম ছিলেন উদ্ধত বিলাসী । অশোক ছিলেন হৃদয়হীন নিষ্ঠুর প্রকৃতির । ভাইকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করলেন । অশোকের পরের ভাই –এর নাম ছিল তিষ্য । অশোক অনুভব করলেন তিনি জ্যেষ্ঠ ভাইকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেছেন, এতে রাজ্যের অনেকেই ক্ষুব্ধ । তার উপর যদি তিষ্যকে হত্যা করেন, প্রজারা বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে । তাই তাকে পাঠিয়ে দিলেন তক্ষশীলায় সেখানকার শাসনকর্তা করে ।
অশোক বৌদ্ধ হলেও অন্য কোন ধর্মের প্রতি তাঁর কোন বিদ্বেষ ছিল না । সকলেই যে যার ধর্মপালন করত । একটি শিলালিপিতে তিনি লিখেছেন, নিজের ধর্মের প্রতি প্রশংসা, অন্যের ধর্মের নিন্দা করা উচিত নয় । পরস্পরের ধর্মমতে শুনে তার সারবস্তু, মূল সত্যকে গ্রহণ করা উচিত । ধর্মাচরণে অধিক মনোযোগী হলেও রাজ্যশাসনের ব্যাপারে সামান্যতম দুর্বলতা দেখাননি । পিতা-পিতামহের মত তিনিও ছিলেন সুদক্ষ প্রশাসক । সুবিশাল ছিল তাঁর রাজ্যসীমা । তিনি শাসন কাজের ভার উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতেই দিতেন এবং প্রয়োজন মত তাদের নির্দেশ দিতেন ।
সম্রাট অশোক তাঁর সমস্ত জীবন প্রজাদের সুখ কল্যাণে, তাদের আত্মিক উন্নতির জন্য ব্যয় করেছিলেন । তবুও তাঁর অন্তরে দ্বিধা ছিল । একজন সম্রাট হিসাবে তিনি কি তাঁর যথার্থ কর্তব্য পালন করেছেন? একদিন গুরুকে প্রশ্ন করলেন, গুরুদেব, সর্বশ্রেষ্ঠ দান কি?
বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন, সর্বশ্রেষ্ঠ দান ধর্মদান । একমাত্র ধর্মের পবিত্র আলোতেই মানুষের অন্তর আলোকিত হয়ে উঠতে পারে । তুমি সেই ধর্মদান কর ।
গুরুর আদেশ নতমস্তকে গ্রহণ করলেন অশোক । তাঁরই অনুপ্রেরণায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের সুমহান বাণী । কিন্তু যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের কোন আলো গিয়ে পৌছায়নি, কে যাবে সেই দাক্ষিণাত্যের, সুদূর সিংহলে ?
অশোকের অবর্তমানে তার সিংহাসনে বসলেন তার নাতি সম্পত্তি । তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি খুব একটা অনুরক্ত ছিলেন না । অশোকের আমলে ধর্মপ্রচারের জন্য প্রজাদের কল্যাণের জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হত, সম্পত্তি সেই ব্যয় কমিয়ে দিলেন । একদিন যিনি ছিলেন সমগ্র ভারতের সম্রাট, আজ তিনি রিক্ত । বুঝতে পারলেন পৃথিবীতে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়েছে, এইবার বিদায় নিতে হবে । অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বেদনাহত চিত্তে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন নৃপতি মহামতি অশোক ।