১১. অ্যারিস্টটল
(খ্রী: পূর্ব ৩৮৪-৩২২)
বিশ্ববিজয়ী বীর সম্রাট আলেকজান্ডার দুঃখ করে বলেছিলেন জয় করবার জন্য পৃথিবীর আর কোন দেশই বাকি রইল না । তাঁর শিক্ষক মহাপন্ডিত অ্যারিস্টটল সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য । জ্ঞানের এমন কোন দিক নেই তিনি যার পথপ্রদর্শক নন । তাঁর Politics গ্রন্থ আধুনিক রাষ্ট্রনীতির সূচনা করেছে । Poetice গ্রন্থের নাট্যতত্ত্ব কাব্যতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছেন । আধুনিক
জীবনবিজ্ঞানের তিনিই জনক । বহু দার্শনিক তত্ত্বের প্রবক্তা ।
তাঁর চিন্তা জ্ঞান মনীষা প্রায় দু্ই হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতাকে বিকশিত করেছিল ।
৩৮৪ খ্রীস্ট পূর্বে থ্রেসের অন্তর্গত স্তাজেইরা শহরে অ্যারিস্টটল জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা ছিলেন চিকিৎসক । নাম নিকোমাকাস ।
শৈশবে গৃহেই পড়াশুনা করেন অ্যারিস্টটল । ১৭ বছর বয়েসে পিতা-মাতাকে হারিয়ে গৃহত্যাগ করেন । ঘুরতে ঘুরতে তিনি এথেন্সে এসে উপস্থিত হন । সেই সময় এথেন্স ছিল শিক্ষার কেন্দ্র সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো গড়ে তুলেছেন নতুন এ্যাকাডেমি । সেখানে ভর্তি হলেন অ্যারিস্টটল । অল্প দিনের মধ্যেই নিজের যোগ্যতায় তিনি হয়ে উঠলেন এ্যাকাডেমির সেরা ছাত্র । প্লেটোও তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন । শিক্ষাদান ছাড়াও নানান বিষয় নিয়ে গবেষণার কাজ করতেন অ্যারিস্টটল তর্কবিদ্যা, অধিবিদ্যা, প্রকৃতিবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান,নীতিশাস্ত্র । অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর গভীর জ্ঞান, অসাধারণ পান্ডিত্যের কথা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল । ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপেরও অজ্ঞাত ছিল না । পুত্র আলেকজান্ডারের জন্ম সময়েই তাঁর শিক্ষার ভার অর্পণ করেন অ্যারিস্টটলের উপর । তখন অ্যারিস্টটল আটাশ বছরের যুবক ।
আলেকজান্ডার যখন তেরো বছরের কিশোর, রাজা ফিলিপের আমন্ত্রণে অ্যারিস্টটল এসে তাঁর শিক্ষার ভার গ্রহণ করলেন । শ্রেষ্ঠ গুরুর দিগ্বিজয়ী ছাত্র । বহু প্রাচীন ঐতিহাসিকের ধারণা অ্যারিস্টটলের শিক্ষা উপদেশই আলেকজান্ডার অদম্য মনোবল লৌহকঠিন দৃঢ় চরিত্র গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল । প্রকৃতপক্ষে একজনের ছিল সমগ্র পৃথিবীকে জয় করে তার উপর প্রভূত্ব করবার প্রবল ইচ্ছা । অন্য জনের ছিল জ্ঞানের নতুন নতুন জগৎ আবিষ্কার করে মানুষের জন্য তাকে চালিত করার ইচ্ছা ।
অ্যারিস্টটলের প্রতি রাজা ফিলিপের ও ছিল গভীর শ্রদ্ধা । শুধু পুত্রের শিক্ষক হিসাবে নয়, যথার্থ জ্ঞানী হিসাবেও তাকে সম্মান করতেন । অ্যারিস্টটলের জন্মস্থান স্তাজেইরা কিছু দুবৃত্তের হাতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল । সেখানকার বহু মানুষ বন্দী জীবন যাপন করছিল । রাজা ফিলিপ অ্যারিস্টটলের ইচ্ছায় শত্রু সেনার হাত থেকে শুধু স্তাজেইরা উদ্ধার করেননি, ধ্বংস্তূপের মধ্যে থেকে শহরকে নতুন করে গড়ে তুললেন ।
অ্যারিস্টটল একদিকে ছিলেন মহাজ্ঞানী, অন্যদিকে সার্থক শিক্ষক । তাই গুরুর প্রতি আলেকজান্ডারের ছিল অসীম শ্রদ্ধা । তিনি বলতেন, পিতার কাছে পেয়েছি আমার এই জীবন আর গুরুর কাছে শিক্ষালাভ করেছি কিভাবে এই জীবনকে সার্থক করা যায় তার জ্ঞান । যখন অ্যারিস্টটল জীবন বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণার কাজ করছিলেন, আলেকজান্ডার তাঁর সাহায্যের জন্য বহু মানুষকে নিযুক্ত করেছিলেন, যাদের কাজ ছিল বিভিন্ন ধরনের মাছ, পাখি, জীবজন্তুদের জীবন পর্যবেক্ষণ করা, তার বিবরণ সংগ্রহ করে পাঠানো । দেশ-বিদেশের যেখানেই কোন পুথি পান্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া যেত,আলেকজান্ডার যে কোন মূল্যেই হোক সেই পুঁথি পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে গুরুর হাতে তুলে দিতেন ।
যখন আলেকজান্ডার এশিয়া জয়ের নেশায় সৈন্যবাহিনী নিয়ে বার হলেন, অ্যারিস্টটল ফিরে গেলেন এথেন্সে । তখন এথেন্স ছিল শিল্প সংস্কৃতি শিক্ষার পীঠস্থান । এখানেই স্কুল স্থাপন করলেন অ্যারিস্টটল । তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ বছর । স্কুলের নাম রাখা হল লাইসিয়াম । কারণ কাছেই ছিল গ্রীক দেবতা লাইসিয়ামের মন্দির ।
৩২৩ খ্রীস্টপূর্বে আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যু হল । এতদিন বীর ছাত্রের ছত্রছায়ায় যে জীবন যাপন করতেন তাতে বিপর্যয় নেমে এল । কয়েকজন অনুগত ছাত্রের কাছ থেকে সংবাদ পেলেন তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে । সক্রেটিসের অন্তিম পরিণতির কথা অজানা ছিল না অ্যারিস্টটলের । তাই গোপনে এথেন্স ত্যাগ করে হউরিয়া দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নিলেন । কিন্তু এই স্বেচ্ছানির্বাসের যন্ত্রণা বেশিদিন ভোগ করতে হয়নি অ্যারিস্টটলকে । ৩২২ খ্রীস্ট পূর্ব তাঁর মৃত্যু হল ।
অ্যারিস্টটলের এই সব ভ্রান্ত মতামত কয়েক শতাব্দী ধরে সমাজকে চালিত তার জন্যে অ্যারিস্টটলকে অভিযুক্ত করা যায় না । উত্তরকালের মানুষেরই দায়িত্ব ছিল তাঁর গবেষণার সঠিক মূল্যায়ন করা । কিন্তু সে কাজে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল ।
সমস্ত ভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও অ্যারিস্টটল মানব ইতিহাসের এক শ্রেষ্ঠতম প্রজ্ঞা – যার সৃষ্ট জ্ঞানের আলোয় মানুষ নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে,মহত্তর পর্যায়ে উন্নীত করেছে ।